পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৩২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাটপর্ব
২৯৭

নপুংসকের প্রশংসা করছ, কি বলতে হয় তা তুমি জান না, আমার অপমান করছ। নপুংসক কি ক’রে ভীষ্মদ্রোণাদিকে জয় করতে পারে? তুমি আমার বয়স্য সেজন্য অপরাধ ক্ষমা করলাম, যদি বাঁচতে চাও তবে আর এমন কথা ব’লো না। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতি মহারথগণের সঙ্গে বৃহন্নলা ভিন্ন আর কে যুদ্ধ করতে পারেন? ইন্দ্রাদি দেবগণও পারেন না। বিরাট বললেন, বহুবার নিষেধ করলেও তুমি বাক্য সংযত করছ না; শাসন না করলে কেউ ধর্মপথে চলে না। এই বলে বিরাট অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরের মুখে পাশা দিয়ে আঘাত করলেন। যুধিষ্ঠিরের নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল, তিনি হাত দিয়ে তা ধ’রে দ্রৌপদীর দিকে চাইলেন। দ্রৌপদী তখনই একটি জলপূর্ণ স্বর্ণ পাত্র এনে নিঃসৃত রক্ত ধরলেন। এই সময়ে দ্বারপাল এসে সংবাদ দিলে যে রাজপুত্র উত্তর এসেছেন, তিনি বৃহন্নলার সঙ্গে দ্বারে অপেক্ষা করছেন। বিরাট বললেন, তাঁদের শীঘ্র নিয়ে এস।

 অর্জুনের এই প্রতিজ্ঞা ছিল যে কোনও লোক যদি যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কারণে যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত করে তবে সে জীবিত থাকবে না। এই প্রতিজ্ঞা স্মরণ ক’রে যুধিষ্ঠির দ্বারপালকে বললেন, কেবল উত্তরকে নিয়ে এস বৃহন্নলাকে নয়। উত্তর এসে পিতাকে প্রণাম ক’রে দেখলেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এক প্রান্তে ভূমিতে ব’সে আছেন, তাঁর নাসিকা রক্তাক্ত, দ্রৌপদী তাঁর কাছে রয়েছেন। উত্তর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজ, কে এই পাপকার্য করেছে? বিরাট বললেন আমি এই কুটিলকে প্রহার করেছি, এ আরও শাস্তির যোগ্য; তোমার প্রশংসাকালে এ একটা নপুংসকের প্রশংসা করছিল। উত্তর বললেন, মহারাজ, আপনি অকার্য করেছেন, শীঘ্র এঁকে প্রসন্ন করুন, ইনি যেন ব্রহ্মশাপে আপনাকে সবংশে দগ্ধ না করেন। পুত্রের কথায় বিরাট যুধিষ্ঠিরের নিকট ক্ষমা চাইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা, আমি পূর্বেই ক্ষমা করেছি, আমার ক্রোধ নেই। যদি আমার রক্ত ভূমিতে পড়ত তবে আপনি রাজ্য সমেত বিনষ্ট হতেন।

 যুধিষ্ঠিরের রক্তস্রাব থামলে অর্জুন এলেন এবং প্রথমে রাজাকে তার পর যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করলেন। বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিরাট তাঁর পুত্রকে বললেন, বৎস, তোমার তুল্য পুত্র আমার হয় নি, হবেও না। মহাবীর কর্ণ, কালাগ্নির ন্যায় দুঃসহ ভীষ্ম, ক্ষত্রিয়গণের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা, বিপক্ষের ভয়প্রদ কৃপাচার্য, মহাবল দুর্যোধন—এঁদের সঙ্গে তুমি কি ক’রে যুদ্ধ করলে? এইসকল নরশ্রেষ্ঠকে পরাজিত ক’রে তুমি গোধন উদ্ধার করেছ, যেন শার্দূলের কবল থেকে মাংস কেড়ে এনেছ।