পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৩৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২৬
মহাভারত

 যধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, তোমার যা অভিরুচি তাই কর, তুমি কৃতকার্য হয়ে নিরাপদে ফিরে এস। তুমি কথা বলতে জান, যে বাক্য ধর্ম সংগত ও আমাদের হিতকর তা মৃদু বা কঠোর যাই হ’ক তুমি বলবে। কৃষ্ণ বললেন, আপনার বুদ্ধি ধর্মাশ্রিত, কিন্তু কৌরবগণ শত্রুতা করতে চান। যুদ্ধ না ক’রে যা পাওয়া যাবে তাই আপনি যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হওয়া বা হত হওয়াই ক্ষত্রিয়ের সনাতন ধর্ম, দুর্বলতা তাঁর পক্ষে প্রশংসনীয় নয়। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সন্ধি করবেন এমন সম্ভাবনা নেই, ভীষ্মদ্রোণাদির ভরসায় তাঁরা নিজেদের প্রবল মনে করেন, আপনি মৃদুভাবে অনুরোধ করলে তাঁরা শুনবেন না। আমি কৌরবসভায় গিয়ে আপনার গুণ আর দুর্যোধনের দোষ দুইই বলব, সকলের সমক্ষে দুর্যোধনের নিন্দা করব। কিন্তু আমি যুদ্ধেরই আশঙ্কা করছি, বিবিধ দুর্লক্ষণও দেখছি, অতএব আপনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ন।

 ভীম বললেন, মধুসূদন, তুমি এমনভাবে কথা ব’লো যাতে শান্তি হয়, যুদ্ধের ভয় দেখিও না। দুর্যোধন অসহিষ্ণু ক্রোধী, কিসে ভাল হয় তা বোঝে না, তাকে মিষ্ট বাক্য ব’লো। আমরা বরং হীনতা স্বীকার করব, কিন্তু ভরতবংশ যেন বিনষ্ট না হয়। তুমি পিতামহ ভীষ্ম ও সভাসদ্‌গণকে ব’লো, তাঁদের যত্নে যেন দুর্যোধন শান্ত হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সৌভ্রাত্র স্থাপিত হয়। আমি শান্তির জন্যই বলছি, ধর্মরাজও শান্তির প্রশংসা করেন; অর্জুন দয়ালু, তিনিও যদ্ধার্থী নন।

 কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, ভীমসেন, ধার্তরাষ্ট্রদের বধ করবার ইচ্ছায় তুমি অন্য সময়ে যুদ্ধের প্রশংসাই ক’রে থাক। তুমি নিদ্রা যাও না, উবুড় হয়ে শোও, সর্বদাই অশান্ত বাক্য বল, অকারণে হাস বা কাঁদ, দুই জানুর মধ্যে মাথা রেখে দীর্ঘকাল চক্ষু মুদে থাক এবং প্রায়ই ভ্রূকুটি ও ওষ্ঠদংশন কর। ক্রোধের জন্যই এমন তুমি বলেছিলে, ‘পূর্বদিকে সূর্যোদয় এবং পশ্চিম দিকে সূর্যাস্ত যেমন ধ্রুব সত্য, আমি গদাঘাতে দুর্যোধনকে বধ করব এও সেরূপ সত্য।’ তুমি ভ্রাতাদের কাছে গদা স্পর্শ ক’রে এই শপথ করেছ, অথচ আজ তুমি শান্তিকামী হয়েছ। কি আশ্চর্য, যুদ্ধকাল উপস্থিত হ’লে যুদ্ধকামীরও চিত্ত বিমুখ হয়, তুমিও ভয় পেয়েছ! পর্বতের বিচলন যেমন আশ্চর্য তোমার কথাও সেইরূপ। ভরতবংশধর, তোমার কুলগৌরব স্মরণ কর, উৎসাহী হও, অবসাদ ত্যাগ কর। অরিন্দম, এই গ্লানি তোমার অযোগ্য, ক্ষত্রিয় নিজের বীর্যে যা লাভ করে না তা ভোগও করে না।

 কোপনস্বভাব ভীম উত্তম অশ্বের ন্যায় কিঞ্চিৎ ধাবিত হয়ে বললেন, কৃষ্ণ