পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫২
মহাভারত

পাণ্ডবদের বিদ্বেষ করে, তার জন্যই আমার ভয়। কন্যাকালে যাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি সেই কর্ণ কি আমার হিতকর বাক্য শুনবে না?

 এই চিন্তা ক’রে কুতী গঙ্গাতীরে গেলেন। দয়ালু সত্যনিষ্ঠ কর্ণ সেখানে পূর্বমুখ ও ঊর্ধ্ববাহু হয়ে জপ করছিলেন। সূর্যতাপে পীড়িত হয়ে শুষ্ক পদ্মমালার ন্যায় কুন্তী কর্ণের উত্তরীয়বস্ত্রের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কর্ণ মধ্যাহ্ণকাল পর্যন্ত জপ করলেন, তার পর পিছনে ফিরে কুন্তীকে দেখতে পেলেন। তিনি সবিস্ময়ে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, আমি অধিরথ-রাধার পুত্র কর্ণ, আপনাকে অভিবাদন করছি, আজ্ঞা করুন আমাকে কি করতে হবে।

 কুন্তী বললেন, কর্ণ, তুমি কৌন্তেয়, রাধার গর্ভজাত নও, অধিরথ তোমার পিতা নন, সূতকুলেও তোমার জন্ম হয় নি। বৎস, রাজা কুন্তিভোজের গৃহে আমার কন্যা অবস্থায় তুমি আমার প্রথম পুত্ররূপে জন্মেছিলে। তুমি পার্থ[১], জগৎপ্রকাশক তপনদেব তোমার জনক। তুমি কবচকুণ্ডল ধারণ করে দেবশিশুর ন্যায় শ্রীমণ্ডিত হয়ে আমার পিতার গৃহে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলে। পুত্র, তুমি নিজের ভ্রাতাদের না চিনে মোহবশে দুর্যোধনাদির সেবা করেছ, তা উচিত নয়। যে রাজলক্ষ্মী অর্জুন পূর্বে অর্জন করেছিলেন, ধার্তরাষ্ট্রগণ যা লোভবশে হরণ করেছে, তা তুমি সবলে অধিকার করে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভোগ কর। কৌরবগণ আজ দেখাক যে কর্ণার্জুন সৌভ্রাত্রবন্ধনে মিলিত হয়েছেন। কৃষ্ণ-বলরামের ন্যায় মিলিত হ’লে তোমাদের অসাধ্য কি থাকতে পারে? তুমি সর্বগুণসম্পন্ন, আমার পুত্রদের সর্বজ্যেষ্ঠ; তুমি পার্থ; তোমাকে যেন কেউ সূতপুত্র না বলে।

 তখন কর্ণ তাঁর পিতা ভাস্করের এই স্নেহবাক্য শুনতে পেলেন—তোমার জননী পৃথা সত্য বলেছেন, তাঁর কথা শোন, তোমার মঙ্গল হবে। মাতাপিতার অনুরোধেও কর্ণ বিচলিত হলেন না। তিনি কুন্তীকে বললেন, ক্ষত্রিয়জননী, আপনার বাক্যে আমার শ্রদ্ধা নেই, আপনার অনুরোধও ধর্মসংগত মনে করি না। আপনি আমাকে ত্যাগ করে ঘোর অন্যায় করেছেন, তাতে আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট হয়েছে। জন্মে ক্ষত্রিয় হ’লেও আপনার জন্য আমি ক্ষত্রিয়োচিত সংস্কার পাই নি, কোন্ শত্রু এর চেয়ে অধিক অপকার করতে পারে? আপনি যথাকালে আমাকে দয়া করেন নি, আজ কেবল নিজের হিতের জন্যই আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন। কৃষ্ণের সহিত মিলিত অর্জুনকে কে না ভয় করে? এখন যদি আমি পাণ্ডবপক্ষে যাই তবে


  1. পৃথা বা কুম্ভীর পুত্র।