পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৩৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৭২
মহাভারত

২। ব্যাস ও ধৃতরাষ্ট্র

 ধৃতরাষ্ট্র শোকার্ত হয়ে নির্জন স্থানে পুত্রদের দুর্নীতির বিষয় ভাবছিলেন এমন সময় প্রত্যক্ষদর্শী ত্রিকালজ্ঞ ভগবান ব্যাস তাঁর কাছে এসে বললেন, রাজা, তোমার পুত্রদের এবং অন্য রাজাদের মৃত্যুকাল আসন্ন হয়েছে, তাঁরা যুদ্ধে পরস্পরকে বিনষ্ট করবেন। কালবশেই এমন হবে এই জেনে তুমি শোক দূর কর। পুত্র, যদি সংগ্রাম দেখতে ইচ্ছা কর তবে আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি দেব।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ব্রহ্মর্ষিশ্রেষ্ঠ, জ্ঞাতিবধ দেখতে আমার রুচি নেই, কিন্তু আপনার প্রসাদে এই যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিবরণ শুনতে ইচ্ছা করি। ব্যাস বললেন, গবল্‌গনপুত্র এই সঞ্জয় আমার বরে দিব্যচক্ষু লাভ করবেন, যুদ্ধের সমস্ত ঘটনা এঁর প্রত্যক্ষ হবে, ইনি সর্বজ্ঞ হয়ে তোমাকে যুদ্ধের বিবরণ বলবেন[১]। ইনি অস্ত্রে আহত হবেন না, শ্রমে ক্লান্ত হবেন না, জীবিত থেকেই এই যুদ্ধ হ’তে নিষ্কৃতি পাবেন। আমিও কুরু-পাণ্ডবের কীর্তিকথা প্রচারিত করব। তুমি শোক ক’রো না, সমস্তই দৈবের বশে ঘটবে, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হবে। এই যুদ্ধে মহান লোকক্ষয় হবে, আমি তার বিবিধ ভয়ংকর দুর্নিমিত্ত দেখতে পাচ্ছি। উদয় ও অস্ত কালে সূর্যমণ্ডল কবন্ধে বেষ্টিত হয়। রাত্রে বিড়াল ও শূকর যুদ্ধ করে, তাদের ভয়ংকর নিনাদ অন্তরীক্ষে শোনা যায়। দেবপ্রতিমা কম্পিত হয়, হাস্য করে, রুধির বমন করে, স্বেদাক্ত হয়, এবং ভূপতিত হয়। যিনি ত্রিলোকে সাধ্বী বলে খ্যাত সেই অরুন্ধতী (নক্ষত্র) বশিষ্ঠের দিকে পিঠ ফিরিয়েছেন। কোনও কোনও স্ত্রী চার পাঁচটি ক’রে কন্যা প্রসব করছে, সেই কন্যারা ভূমিষ্ঠ হয়েই নাচছে গাইছে আর হাসছে। বৃক্ষ ও চৈত্য প’ড়ে যাচ্ছে, আহুতির পর যজ্ঞাগ্নি থেকে দুর্গন্ধময় নীল লোহিত ও পীত বর্ণের শিখা বামাবর্তে উঠছে। স্পর্শ গন্ধ ও স্বাদ বিপরীত হচ্ছে। পক্ষীরা পক্কা পক্কা রব ক’রে ধ্বজাগ্রে ব’সে রাজাদের ক্ষয় সূচনা করছে। ধৃতরাষ্ট্র, তোমার আত্মীয় ও সুহৃদ্‌বর্গকে ধর্মসংগত পথ দেখাও, তুমি এই যুদ্ধ নিবারণে সমর্থ। জ্ঞাতিবধ অতি হীন কার্য এবং আমার অপ্রিয়, তুমি তা হতে দিও না। যাতে তুমি পাপগ্রস্ত হবে তেমন রাজ্যে তোমার কি প্রয়োজন? পাণ্ডবরা তাদের রাজ্য লাভ করুক, কৌরবরা শান্ত হ’ক।

  1. সঞ্জয় বক্তা এবং ধৃতরাষ্ট্র শ্রোতা—এইভাবে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের সমগ্র ঘটনা মহাভারতে বিবৃত হয়েছে।