পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৪০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভীষ্মপর্ব
৩৭৭

হচ্ছে, মুখ শুখচ্ছে, শরীর কাঁপছে, রোমহর্ষ হচ্ছে, হাত থেকে গাণ্ডীব প’ড়ে যাচ্ছে। আমি বিজয় চাই না, যাঁদের জন্য লোকে রাজ্য ও সুখ কামনা করে তাঁরাই যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে এসেছেন। স্বজন বধ ক’রে আমাদের কোন্ সুখ হবে? হায়, আমরা রাজ্যের লোভে মহাপাপ করতে উদ্যত হয়েছি। যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ আমাকে নিরস্ত্র অবস্থায় বধ করে তাও আমার পক্ষে শ্রেয় হবে। এই ব’লে অর্জন ধনুর্বাণ ত্যাগ করে রথের মধ্যে ব’সে পড়লেন।

 বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, এই সংকটকালে তুমি মোহগ্রস্ত হ’লে কেন? ক্লীব হয়ো না, ক্ষুদ্র হদয়দৌর্বল্য ত্যাগ কর। অর্জুন বললেন, মধুসূদন, পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণকে আমি কি ক’রে শরাঘাত করব? মহানুভাব গুরুজনকে হত্যা করা অপেক্ষা ভিক্ষান্ন ভোজন করাও শ্রেয়। আমি বিহ্বল হয়েছি, ধর্মাধর্ম বুঝতে পারছি না, আমাকে উপদেশ দাও, আমি তোমার শরণাপন্ন।

 কৃষ্ণ বললেন, যারা অশোচ্য তাদের জন্য তুমি শোক করছ আবার প্রজ্ঞাবাক্যও বলছ। মৃত বা জীবিত কারও জন্য পণ্ডিতগণ শোক করেন না।—

দেহিনোঽস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি॥
অবিনাশি তু তদ্ বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি ॥

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহাতি নরোঽপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
নন্যানি সংযাতি নবানি দেহী॥

—দেহধারী আত্মার যেমন এই দেহে কৌমার যৌবন জরা হয়, সেইরূপ দেহান্তরপ্রাপ্তি ঘটে; ধীর ব্যক্তি তাতে মোহগ্রস্ত হন না। যাঁর দ্বারা এই সমস্ত বিশ্ব ব্যাপ্ত তাঁকে অবিনাশী জেনো; কেউ এই অব্যয়ের বিনাশ করতে পারে না। ইনি কদাচ জন্মেন না বা মরেন না, অথবা একবার জন্মগ্রহণ ক’রে আবার জন্মাবেন না—এও নয়; ইনি জন্মহীন নিত্য অক্ষয় অনাদি, শরীর হত হ’লে এই আত্মা হত হন না।