পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১০৬

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১০০
মাঝির ছেলে

সমুদ্রের উন্মত্ততা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে বুঝতে পারছিল, কিন্তু বন্দরের কাছে পৌছবার সময় যে অবস্থায় পৌছেছিল, ঝড় যে তার চেয়ে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে কি করে সে কল্পনা করতে পারে নি। আধঘণ্টা পরে নিজেকে যখন তার লঞ্চের সঙ্গে বেঁধে রাখবার দরকার হল, তখন সে বুঝতে পারল ঝড়ের ভূমিকা আর আসল ঝড় বলতে ভিমনা কি বুঝাতে চেয়েছিল।

 পাহাড় সমান ঢেউ লঞ্চের ওপর আছড়ে পড়তে থাকে, লঞ্চের সঙ্গে নাগা তলিয়ে যায় ফেনিল জলের নিচে, মনে হয় আর ভেসে উঠবে না। তারপর আবার লঞ্চ ভেসে ওঠে কয়েক মুহূর্তের জন্য, দম না নিতে নিতে আরেকটি জলের পাহাড় তাকে গ্রাস করে। ভিমনার হুকুমে ডেনিস আর যাদববাবু নিচে চলে গেছেন, সেখানে তাঁরা হয়ে আছেন বন্দী। ডেকের চেয়ে সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা অনেক নিরাপদ বটে, কিন্তু ওভাবে বন্দী অবস্থায় লঞ্চ ডোবার প্রতীক্ষা করে থাকার চেয়ে ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া নাগার কাছে অনেক ভাল। কোনদিকে লঞ্চ চলেছে কে জানে! ইঞ্জিন কি চলছে, না জলকন্যা শুধু ভেসে চলেছে ঝড়ের ঠেলায়? ভিমনা কি করছে জানতে পারলে নাগা খুশী হত। লঞ্চ বাঁচবে না জেনেও যাদববাবুর হুকুমে এতগুলি মানুষের প্রাণের দায়িত্ব নিয়ে বন্দরের আশ্রয় সে ছেড়ে এসেছে, কোথায় যাবে কি করবে কিছু কি সে ঠিক করে নি?

 তারপর এক সময় নাগা বুঝতে পারল, সে যেখানে আছে সেখানে থাকলে লঞ্চ না ডুবলেও সে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দম আটকে মরে যাবে। নাগা নিজের বাঁধনটা খুলে ফেলল, ভাবল, মরতেই যদি হয় নিচে গিয়ে সকলের সঙ্গে মিলে একসাথেই মরা যাক। পরমুহুর্তে বড় একটা ঢেউ এসে লাইফ বেল্ট আটা নাগাকে লঞ্চ থেকে তুলে নিয়ে চলে গেল।

 নাগার মনে হ’ল, এতক্ষণে সে কি আসল সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছে, একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে?