পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
মাঝির ছেলে

 তার মনে পড়ল, গরীব মাঝিদের মধ্যে চরণ মাঝি আরও গরীব। গাছের কলাকে পাকতে সময় না দিয়ে সে কি সাধে আগুনের আঁচে পাকিয়েছে? ওকে আর ওর বৌ ও ছেলেমেয়েকে উপোস করিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার মধ্যে আর মজা কি আছে?

 মাধববাবুর স্ত্রী বললেন, ‘এটা ওটা কিনছ তো খুব, ঠাকুরপো কই? নৌকা কই?’ তখন কলা কেনার বাহাদুরি ভুলে চিন্তিত হয়ে মাধববাবু বললেন, ‘তাই তো যাদবকে তো দেখছি না। নৌকা নিয়ে আসবে লিখেছিলো না?’

 নাগা তাকে যাদববাবুর খবর জানিয়ে দিল। শুনে মাধববাবুর স্ত্রী বললেন, ‘দেখলে তো? দেখলে তো ঠাকুরপোর কাণ্ডখানা? আমরা আজ আসছি, এতকাল পরে আসছি, আজকে তার দরকার পড়ে গেল হাত দেখাবার!’

 মাধববাবু বললেন, ‘নৌকায় গিয়ে বসি চল। তুই কেরে?’ নাগা হেসে বলল, ‘আমি? আমি তো কেউ না কর্তা!’

 ‘ফাজলামি হচ্ছে, না?’ বলে মাধববাবু রাগ করে সপরিবারে অগ্রসর হলেন। তখন বোধ হয় তার মনে পড়ল, ভাই-এর নৌকা কোথায় তিনি তো জানেন না। অগত্যা নৌকাটি দেখিয়ে দেবার জন্য নাগাকেই তিনি আহ্বান করলেন।

 মাধববাবুর রাগের কারণটা নাগা বুঝতে পারে নি, মিছামিছি ধমক খেয়ে তার রাগ হয়েছিল। সে উদাসভাবে বলল, ‘কেডা জানে নাও কই!’

 মাধববাবু তখন মিষ্টি গলায় বললেন, ‘আয় বাবা আয়, রাগস্‌ ক্যান্‌?’

 কথার মিষ্টতার বদলে এতক্ষণে মাধববাবুকে এদেশী ভাষায় কথা বলতে শুনেই নাগার রাগ জল হয়ে গেল। শুধু নৌকাই সে দেখিয়ে দিল না, ছেলেমেয়ে মালপত্র নিয়ে নৌকায় উঠতে তাদের সাহায্য করল, পা দিয়েই বড় মেয়েটি টলে নদীতে পড়ে যাবার উপক্রম করলে তাকে সামলে দিল, মাধববাবুর স্ত্রীর অনুরোধে দেড় বছরের ছেলেটিকে কিছুক্ষণের জন্য কোলেও নিল। তারপর গিয়ে বসল নিজের নৌকার গলুই-এ। সেখানে বসে দেখতে লাগল এদের কাণ্ডকারখানা।