পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
মাঝির ছেলে
১৪

বসল। নৌকা ছেড়ে সকলে চলে গেল বটে, যাওয়ার আগে হারুকে শূন্যে তুলে আরেকবার নদীর জলে ফেলে দিয়ে গেল।

 গালটা দিয়েই হারু টের পেয়েছিল কাজটা ভাল হয় নি, এরা তার ভাইপো নয়, এদের যা খুশি তাই বলা চলে না। মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবার বদলে শুধু জলে ফেলে দিয়ে চলে গেছে তাই তার অনেক ভাগ্য। এবার নৌকায় উঠে হারু আর রাগারাগি করল না, নাগাকে শুধু বলল, ‘যা গিয়া, তুইও যা গিয়া। আর তর মুখ দেখুম না। দূর কইরা দিলাম তরে।’

 নাগা বলল, ‘তোমার কওন লাগব না, আমি নিজেই যামু গিয়া। রামতলার ছোট কর্তার নায়ে কাম পাইছি।’

 ‘কাম পাইছস? কত দিব?’

 ‘যা দিবার দিব।’

 তারপর দুজনেই চুপচাপ। ভিজা কাপড় ছেড়ে হারু এক ছিলুম তামাক সেজে জলহীন হুঁকোয় সোঁ সোঁ করে টানতে থাকে আর নদীর ঢেউ চারিদিকে শব্দ করে ছলাৎ ছলাৎ। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে নাগার। কি বোকা গরীব মানুষেরা! জীবনে দুঃখ কষ্ট তো হাজার রকম আছেই, তার ওপর অকারণে ঝগড়াবিবাদ করে সর্বদাই কত অশান্তি টেনে আনে। দু’টি মিষ্টি কথা আর একটু ভাল ব্যবহার দিয়ে মানুষকে কত সুখী করা যায়, তাতে পয়সাও লাগে না। অথচ সবাই যেন পাগলা কুকুরের মত একজন আরেক জনের টুঁটি কামড়ে ধরবার জন্য সব সময় তৈরি হয়ে আছে।

 হঠাৎ হারু মাঝি নরম গলায় বলল, ‘যা, খাইয়া আয় গিয়া।’

 নাগা বলল, ‘না, খামুনা।’

 হারু মাঝি তখন গভীর অভিমানের সঙ্গে ভাবতে লাগল, এতো উচিত নয় নাগার, তাকে নদীতে ঠেলে ফেলে দিয়ে এখন নিজে রাগ করা।

 মিষ্টি কথা বলতে মানুষের কৃপণতার জন্য নাগা মনে মনে আফসোস করছিল, হারু মাঝি মিষ্টি মিষ্টি কথাই বলতে লাগল। কিন্তু সুখ ত নাগার হল না। কথাগুলি হারু যেন যাদববাবুর নৌকার ভবিষ্যৎ মাঝিকে বলছে, নাগাকে বলছে না।