পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাঝির ছেলে
২০

 মাধববাবুর স্ত্রী কিন্তু নাগাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছেন। তিনি জন্মেছেন কলকাতায়, বিয়ের পর প্রথম প্রথম দু’চারবার শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন, তারপর আর আসেন নি। বিশ বছর ধরে নদীর মধ্যে তিনি শুধু দেখেছেন কলকাতার গঙ্গা আর রেলগাড়িতে চেপে পুলের ওপর দিয়ে যাবার সময় দু’চারটে শান্ত ও সঙ্কীর্ণ নদী। এখানকার নদীর যে এপার ওপার দেখা যায় না; এমন বড় বড় ঢেউ ওঠে নদীতে, আর বছরের এ সময়টা ঝড় উঠে নৌকা ডুবিয়ে দেয়, এসব একরকম ভুলেই গিয়েছিলেন। এবার পদ্মাকে দেখেই তাঁর ভয় হয়েছিল, তারপর একটা কাণ্ড করে পদ্মা তাঁকে আরও ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

 একদিন তিনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছেন, পাহারাদার হিসাবে সঙ্গে গিয়েছে নাগা। পদ্মা এখানে ধীরে ধীরে তীর গ্রাস করেছে, কয়েক জায়গায় নদীর তীর একেবারে খাড়া। মার মৃদু মৃদু বারণ না মেনে খোকা আর কণিকা ছুটে গিয়ে সবে এরকম একটা খাড়াইএর ওপর দাঁড়িয়েছে, খানিক তফাতে চল্লিশ পঞ্চাশ হাত ডাঙ্গা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল আর এখানে একটা চীৎকার করে কণিকা পড়ে গেল জলে। মনে হল যেন ইচ্ছে করেই লাফিয়ে পড়েছে। কিন্তু ইচ্ছে করে কি আর অতটুকু মেয়ে সাঁতার পর্যন্ত না জেনে এমন করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে? হঠাৎ এত কাছে পাড় ভেঙ্গে পড়ার শব্দে চমকে উঠে দিশেহারা হয়ে হয়তো কোন্‌দিকে পালাবে ঠিক করতে পারে নি, নয়তো পালিয়ে আসতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে। কণিকা যে ভাবেই পড়ে থাক, নাগা ইচ্ছে করেই নদীতে লাফিয়ে পড়ল এবং কণিকাকে নিয়ে ওপরে উঠে এল যেখানে এইমাত্র ডাঙ্গা ভেঙ্গে পড়েছে সেইখানে তীরের ঢাল বেয়ে। তার ওপরে উঠবার সুবিধার জন্যই যেন হাতের কাছে ডাঙ্গাটা ভেঙ্গে পড়েছিল।

 বাড়ি ফিরে বুকের ধড়ফড়ানি কমবার পর খোকার মা নাগাকে বললেন, ‘তুই যে ওখান দিয়ে উঠে এলি নাগা, আবার যদি ভেঙ্গে পড়ত?’ নাগা বলল, ‘ক্যামনে ভাঙ্গবো? নদী তলার মাটি খাইবো তবে স্যান উপরের মাটি ভাইঙ্গা পড়ব?’