পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাঝির ছেলে
২২

খাটে। কাঠের সিন্দুক এঘর থেকে ওঘরে যাবে, আম কাঠের প্রকাণ্ড গুঁড়ি থেকে তাড়াতাড়ি কয়েকটা কাঠ চ্যালা করে দিতে হবে, দুরন্ত গাইটা দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে গেছে, তাকে বেঁধে আনতে হবে, নাগা ছাড়া এসব করবে কে? এমন ভাবে তিনি কাজগুলি করতে বলেন যে নাগার মনে এ প্রশ্নও জাগে না, সে যখন ছিল না তখন এসব কাজ করত কে?

 নৌকার মাঝিদের মধ্যে নাগা আর পরেশ যাদববাবুর বাড়িতে থাকে, জীতু নৌকায় থাকে আর নকুল থাকে এই গ্রামে তার নিজের বাড়িতে। নকুলের সঙ্গে নাগার অনেকদিনের পরিচয়, অনেক মাথা ঘামালে দু’জনের মধ্যে কুটুম্বিতার একটা সম্পর্ক নাকি খুঁজে বার করা যায়। কিন্তু সে এমন সম্পর্ক যে নাগা তাকে কি বলে ডাকবে ঠিক করবার উপায় নেই। ভদ্রসমাজ হলে ‘নকুলবাবু’ বলে কাজ চালান যেত কিন্তু তারা একজনও ভদ্রলোক নয়, নাগা তাই সোজাসুজি তাকে মামু বলে ডাকে আর নকুল তাকে বলে ভাইগ্‌না।

 যখন তখন নাগা নকুলের বাড়ি যায় আর যাদববাবুর বাড়িতে যত সুখেই থাক এখানে সেই সুখের ওপরে খানিকটা বাড়তি স্বস্তি অনুভব করে। মনে হয় এ যেন আপন জগৎ, গরীব মাঝির বাড়ি। আটখামারের বাড়িতে যেমন আছে হারু মাঝি, তার বৌ আর এখানেও তেমনি আছে নকুল মাঝি, তার বৌ আর রূপা। আটখামারের বাড়ির অনাদর শুধু নেই।

 নকুল খুশী হয়ে বলে, ‘আয় ভাইগ্‌না বয়। খবর কি?’ একঘণ্টা আগে সে একসঙ্গে নৌকা থেকে নামলেও নকুল খবর জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু খাপছাড়া শোনায় না। নৌকায় দেখা হওয়া আর বাড়িতে দেখা হওয়ার মধ্যে অনেক তফাত। নাগাকে খবর বলতে হয় না, নকুল নিজেই একধার থেকে নিজের আর রাজ্যের লোকের সুখদুঃখের খবর আওড়াতে থাকে। কথা বলতে বড় ভালবাসে নকুল।

 নকুলের একটা চোখ কানা। পঞ্চু নামে নাগার চেয়েও বয়সে বড় একটি ছেলে ছিল নকুলের, বছর দুই আগে চোখটা কানা করে দিয়ে সে পালিয়ে গেছে। তারপর এ পর্যন্ত আর গ্রামেও আসে নি, কোন খবরও দেয় নি। লোকে বলে সে এখন সদরে পুলিশে চাকরি করছে, কিন্তু নকুল