পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪১
মাঝির ছেলে

 কিন্তু যাদববাবুর কাছে টাকা চাইতে নাগা কিছুতেই রাজী হল না। মুখ ভার করে হারু চুপ করে রইল। নাগার সঙ্গে তার যেন বলার কথা আর কিছুই নেই। টাকার কথাতেই সব কথা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আরেকটা কথা হারুর বলার ছিল। নাগা যখন নৌকা থেকে নেমে যাচ্ছে, গলা নরম করে হিতাকাক্ষী গুরুজনের মত সে বলল, ‘আমার কাছে আংটি থুইয়া যা নাগা, তুই হারাইয়া ফেলবি।’

 এমন একটা সদুপদেশও নাগা কানে না তোলায় এবার হারু মাঝি একেবারে গালাগালি আরম্ভ করে দিল। নাগা মাথ, নীচু করে নৌকা থেকে নেমে গেল।

 মনের সমস্ত আনন্দ ও উৎসাহ তখন তার গভীর বিষাদে তলিয়ে গেছে। গরীবের লজ্জা-সরম থাকতে নেই, আত্মসম্মান জ্ঞান থাকতে নেই? কিন্তু এসব তো গরীবদেরই বেশী করে থাকা উচিত, তাদের লজ্জা দেবার জন্য আর অপমান করার জন্য সকলে সব সময় তৈরী হয়ে রয়েছে। টাকা পয়সার ব্যাপারে হারু মাঝির মত নীচতা, নাগা আরও অনেকের মধ্যে দেখেছে, অন্য ব্যাপারে সামান্য অপমানেও যারা রুখে দাঁড়ায়। হারু মাঝিও তো ভীরু নয়, কাপুরুষ নয়। গত আশ্বিনে একবার তারা মাঝনদীতে ঝড়ের মধ্যে পড়েছিল, প্রাণ বাঁচে কি বাঁচে না এই রকম অবস্থা, একটা ডিঙ্গি নৌকার দু’জন লোককে বাঁচাতে গিয়ে হারু মাঝি তো নিজের প্রাণের কথা তখন ভাবে নি। শুধু গরীব বলেই কি টাকা পয়সার ব্যাপারে এদের মন ছোট হয়ে গেছে? সেটা অসম্ভব নয়। পয়সা না থাকাটা যে কি জিনিস তাও সে ভাল করে জানে। যথাসময়ে স্টীমার এল, কিন্তু যাদববাবু এলেন না। মাঝিরা পড়ে গেল বিপদে। যে স্টীমারে আসবার কথা সে স্টীমারে না এলেও যাদববাবুর জন্য অপেক্ষা করাই চিরদিনের নিয়ম, কিন্তু সকালের স্টীমারের অপেক্ষায় এখানে রাত কাটাবার উপায় তো আজ তাদের নেই। খোকা আর কণিকাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে আজ রাতেই, নয়তো হুলুস্থূল পড়ে যাবে। কিন্তু এখন করমতলায় ফিরে গেলে কাল সকালে আবার নৌকা নিয়ে আটখামারে আসতে হবে।

 সকলে গজর গজর করতে থাকে, খোকা আর কণিকার ওপর তাদের