পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাঝির ছেলে
৫৬

লাগানোর কথা আলোচনার জন্য এরা দুজন যেন আসে নি, ওসব তুচ্ছ বিষয়ে আলোচনা করার এতটুকু ইচ্ছাও যেন কারও নেই। নেহাত কথাটা উঠে পড়েছে তাই কিছু বলা, নয়তো ওসব আইন-বিরুদ্ধ ব্যাপারের সঙ্গে তাদের কিসের সম্পর্ক! তবু আলোচনা ক্রমে স্পষ্টরূপ নিতে থাকে, ক্রমে ক্রমে যেন পরামর্শে দাঁড়িয়ে যায়।

 শুনতে শুনতে নাগার মনে তোলপাড় চলতে থাকে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে নৌকা বোঝাই তামাক পাতায় মোড়া সিদ্ধি-পাতার গাঁট আর জল-পুলিশের আকস্মিক আবির্ভাব। যাদববাবু যদি এই বিপজ্জনক কাজে নামেন, তাকেও যাদববাবুর সঙ্গে থাকতে হবে। যাদববাবুকে ত্যাগ করার কথা নাগা ভাবতেও পারে না। চীনাম্যানটি দু’বার এখানে তার উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেছে, দু’বার যাদববাবু তাদের জানিয়ে দিয়েছেন, সে তার নিজের লোক সর্বদা সে সঙ্গে থাকে, তার কাছে কিছুই গোপন করার নেই। এরপর কি আর যাদববাবুকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবা যায়। তিনি ভাল কাজ করুন আর মন্দ কাজ করুন, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় থাক আর নাই থাক?

 তিনদিন সময় হাতে ছিল। যাদববাবু বললেন, ‘একবার করমতলায় চল ভিমনা। পুলিশ বাজেয়াপ্ত করার আগে একবার সে লঞ্চখান দেখাইয়া আনি।'

 ভিমন একগাল হেসে বলল, “চলেন কর্তা।”

 বিকালে জলকন্যা করমতলায় পৌঁছল। নাগাকে সঙ্গে নিয়ে যাদববাবু বাড়ি গেলেন। বাড়িতে পা দিয়েই নাগা টের পেল ঠিক ঝড়ের পরের অবস্থা। মাধববাবু একবার কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে একেবারে স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন। সকলের মুখ গম্ভীর হয়েই ছিল, নাগাকে দেখে যেন আরও গম্ভীর হয়ে গেল। পরেশ দূর থেকে একটু শয়তানি হাসি হাসল, যার অর্থ-আবার এসেছিস? মজা টের পাবি।

 কেবল যাদববাবুর স্ত্রী খুশী হয়ে বললেন, “নাগা আইছস?’—বলে এত তাড়াতাড়ি তাকে ক্ষীর আমি আর মুড়ি খেতে দিলেন যেন নাগার খিদের তাগিদের চেয়েও নাগাকে খাওয়াবার তাগিদটা তার বেশী জোরালো।