পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯১
মাঝির ছেলে

 বর্ষা নামতেই কণিকা কলকাতায় ফিরবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। সারাদিন তার ঘ্যান ঘ্যানানির কামাই নাই। কণিকার মা মেয়ের মত অস্থির হয়ে না। উঠলেও শহরে ফিরবার জন্য তার মনও যে ছটফট করছে সেটা স্পষ্টই বুঝা যায়। আর সম্পত্তির সব ব্যবস্থা শেষ করে কবে এখান থেকে নড়তে পারবেন জানা না থাকায় মাধববাবুর মুখে যে হতাশার ভাব ফুটে উঠেছে তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, দেশের বাড়ীতে বাস করবার সাধটা তার কি মেটাটাই মিটে গিয়েছে। চারিদিকে শুধু জল আর কার্দী, জঙ্গলের সাপ ঘরে আশ্রয় খুঁজতে আসছে, সন্ধ্যা থেকে মশার কামড়ে গা ফুলে উঠছে, পোকামাকড় অতিষ্ঠা করে তুলেছে। জীবন। কলকাতার অজস্র সুবিধা ও বৈচিত্র্যের অভাবেও এতকাল কোনমতে কাটানো গিয়েছে, কিন্তু এত কষ্ট সহ করে কি মানুষ থাকতে পারে।

 মাধববাবু অগত্যা একদিন স্ত্রী ও কন্যাকে কলকাতায় রেখে আসতে গেলেন। ফিরে যে তিনি এলেন সেটা শুধু সম্পত্তির মমতায়, যাদববাবুর হাতে একটা মাসের জন্যও সব ছেড়ে দিয়ে যাবার ভরসা আর তার নেই। এসে হয়তো শুনবেন যাদববাবু সব বিক্রি করে বড় জাহাজ কিনে বিলাতে হাওয়া খেতে গেছেন,—যদিও দলিলে তার স্বাক্ষর ছাড়া যাদববাবুর পক্ষে। সেটা করা সম্ভব নয়।

 যাওয়ার আগে কণিকা বলল, “কলকাতা দেখেছিস নাগা? ব্যাস নি। কখনো? আমাদের সঙ্গে আয় না?”

 কিন্তু নাগার কি কোথাও যাওয়ার উপায় আছে। তার কত কাজ, কত দায়িত্ব।

 “বৌকে ফেলে যেতে পারবি না, না?”

 “বৌ কই দিদিমণি?”

 “হবে তো দু’দিন বাদে।”—কণিকা ঠোঁট উল্টে বলে,—“যাই বলিস, বড় নোংরা নকুলের মেয়েট। একটু সাবান টাবান মাখাস। আর এমন হিংসুটি মেয়েটা।”

 রূপা হিংসুটি? না, কণিকার মত স্বার্থপরতা বা হিংস রূপার নেই। কিন্তু হিংসুট না হোক, কণিকার তুলনায় রূপা সত্যই বড় নোংরা।