পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আমাকে দেবতুল্য স্বামী দিয়াছেন, তিনি আমার সহায় হউন, সেই স্বামীর যেন কখনও ত্রুটি না করি সেই স্বামীতে যেন আমার অচলা ভক্তি থাকে, আমি যেন তাঁহারই চির-পতিব্রতা দাসী হইয়া থাকি। নরেন্দ্র! ভাই নরেন্দ্র! বাল্যকালে তুমি আমাকে ধর্মশিক্ষা দিয়াছিলে, এই পবিত্র দেবমন্দিরে আবার সেই শিক্ষা দাও। তাই আমরা প্রতিশ্রুত হই, ধর্মপথ কখনও ত্যাগ করিব না, আমি জনমে-মরণে চির-পতিব্রতা হইয়া থাকিব।”—কথা সাঙ্গ করিয়া হেমলতা দেবপ্রতিমূর্তির সম্মুখে প্রণতা হইল; নরেন্দ্রও নিঃশব্দে প্রণত হইলেন।

 উঠিয়া আবাব সযত্নে নরেন্দ্রের হাত ধরিয়া হেমলতা বলিল, “ভাই নরেন্দ্র, এক্ষণে রাত্রি অধিক হইয়াছে, বিদায় দাও, আমি চিরকাল তোমাকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় ভালবাসিব, তুমিও তোমার কনিষ্ঠা ভগিনীকে মনে রাখিও।”

 একবিন্দু জল নয়ন হইতে মোচন করিয়া হেমলতা ধীরে ধীরে মন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। যতক্ষণ দেখা যাইল, নরেন্দ্র হেমেব দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পর? তাহার পর এ জগতের মধ্যে নিতান্ত দুর্ভাগা লোকও নরেন্দ্রের সে রজনীর শোক ও বিষাদ দেখিলে বিষণ্ণ হইত। অভাগার হৃদয় আজ শূন্য হইল, অভাগার প্রণয়-ইতিহাস আজ সমাপ্ত হইল।

 মাধবীকঙ্কণটি হৃদয়ে ধারণ করিয়া নরেন্দ্র যমুনাতীরে বসিয়া ছিলেন। হেমলতার কথাগুলি তাহার মনে বার বার উদয় হইতে লাগিল—"এটি উন্মোচন কর, ইহাতে আমার অধিকার নাই, নরেন্দ্র আমি অবিশ্বাসিনী পত্নী নহি।” নরেন্দ্রর কি সে প্রণয় নিদর্শনটি রাখিবার অধিকার আছে? সমস্ত রজনী নরেন্দ্র সেটি হৃদয়ে ধারণ করিয়া রহিলেন, প্রাতঃকালে শূন্য হৃদয়ে সেটি বিসর্জন দিলেন, যমুনার জলে ভাসিতে ভাসিতে শুষ্ক কঙ্কণটি অদৃশ্য হইয়া গেল।

পঁয়ত্রিশ

আমাদের আখ্যায়িকা শেষ হইল, কেবল আখ্যায়িকার নায়ক-নায়িকাদিগের সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে বাকি আছে।

 পূর্বেই বলা হইয়াছে, শাসুজা বঙ্গদেশ হইতে দ্বিতীয়বার যুদ্ধার্থে আগমন করিতেছিলেন। শীতকালে প্রয়াগের নিকট সুজা ও আওরংজীবের মধ্যে মহাযুদ্ধ হয়। দুই দিনের যুদ্ধের পর সুজা পরাস্ত হইয়া পলায়ন করিলেন, যশোবন্তসিংহ এই যুদ্ধে আওরংজীবের বিরুদ্ধাচরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই

১০২