পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কহিতে আইসে, তখন সেই আনন্দদায়িনী কথায় হেমের হৃদয় ঈষৎ নৃত্য করিয়া উঠে। যখন দুই-একদিনের জন্যও নরেন্দ্র ভিন্ন গ্রামে গমন করে, তখন প্রাতে, মধ্যাহ্নে, সায়ংকালে হেম অন্যমনা হইয়া থাকে।

 তথাপি হেমের মনের কথা কেউ জানে না। কপোতী যেরূপ আপন শাবকটিকে অতি যত্নে কুলায় লুকাইয়া রাখে, বালিকা এই নূতন ভাবনাটিকে অতি সঙ্গোপনে হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকাইয়া রাখিত। বালিকা নিজেও সে ভাবটি ঠিক বুঝিতে পারিত না, না বুঝিয়াও সে প্রিয় ভাবটি সযত্নে জগতের নিকট হইতে সঙ্গোপন করিত।

 বৃদ্ধ নবকুমার হেমকে এখনও বালিকা মনে করিতেন, সেই বালিকার উদার সরল মুখখানি দেখিলে কেনই বা মনে না করিবেন? বিবাহ দিলে একমাত্র কন্যা পরের হইবে, এই ভয়ে যতদিন পারিলেন, বিবাহ না দিয়া রাখিলেন। শ্রীশচন্দ্রও হেমের হৃদয়ের পরিচয় পাইল না, কিরূপেই বা পাইবে? হেম তাহার সহিত সর্বদাই সরল-হৃদয়ে নিঃসংকোচে কথা কহিত। শ্রীশচন্দ্রের নিকট প্রত্যহ কিছু কিছু পড়িতে শিখিত, পাঠ বলিয়া যাইত, পড়া হইলে পড়া দিত, যত্নের সহিত শ্রীশচন্দ্রের উপদেশবাক্য গ্রহণ করিত। নরেন্দ্র পড়াইতে আসিলে বালিকা মনঃস্থির করিতে পারিত না, নরেন্দ্র পড়া লইতে আসিলে বালিকা ভাল করিয়া বলিতে পারিত না, সমস্ত ভুল যাইত। সংসার-কার্যের তাবৎ ঘটনাই যেন শ্রীশচন্দ্রের নিকট বলিত, শ্রীশের উপদেশ ভিন্ন কোন কার্য করিত না। নরেন্দ্র উপদেশদাতা নহেন, নরেন্দ্র আসিলে অন্য কথা হইত অথবা অনেক সময় কথা হইত না; সুতরাং শ্রীশ মনে করিত যে, বালিকার হৃদয়ে যেটুকু প্রণয় বা স্নেহ আছে তাহা শ্রীশকেই অবলম্বন করিয়াছে।

॥ পাঁচ॥

 এইরূপে কিছুকাল অতিবাহিত হইল। একদিন সায়ংকালে শ্রীশ ও নরেন্দ্র একখানি নৌকায় আরোহণ করিয়া গঙ্গায় বিচরণ করিতেছিল। নরেন্দ্র আপন বলপ্রকাশ অভিলাষে দাঁড়ীকে উঠাইয়া দিয়া দুই হাতে দুইটি দাঁড় ধারণ করিয়া নৌকা চালাইতেছে, শ্রীশ স্থিরভাবে বসিয়া প্রকৃতির সায়ংকালীন শোভা দর্শন করিতেছিল। শ্রীশ ও নরেন্দ্রের মধ্যে কখনই যথার্থ প্রণয় ছিল না, অল্প অল্প কথা লইয়া তর্ক হইতে লাগিল। নরেন্দ্রের হস্ত হইতে সহসা একটি দাঁড় স্খলিত হওয়াতে নরেন্দ্র পড়িয়া গেল, শ্রীশ উচ্চহাক্ত হাসিয়া বলিল, “যাহার কাজ, তাহাকে দাও বীরত্বে আবশ্যক নাই।”

 সেই সময়ে তীরস্থ অট্টালিকা হইতে হেমলতা দেখিতেছিল, হেমলতার সম্মুখে অপদস্থ হইয়া নরেন্দ্র মর্মান্তিক কষ্ট পাইয়াছিল, তাহার উপর শ্রীশের রহস্যকথা সহ্য হইল

১৩