পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হইল। কৃষকগণ আনন্দে ধান্য কাটিতে লাগিল। গ্রামে, গৃহে, গোলায় ধান্য পরিপূর্ণ হইল জগৎ আনন্দিত হইল, কিন্তু হেমের নিরানন্দ হৃদয় শান্ত হইল না। সুন্দর আশ্বিন মাসে পূজার রব উঠিল, চারিদিকে আনন্দধ্বনি উঠিল, আকাশ পরিষ্কার হইল, কিন্তু হেমলতর হৃদয়াকাশ তমসাচ্ছন্ন। আবার শীতকাল আসিল, আনন্দে কৃষকগণ আবার ধান্য কাটিল, আনন্দে সংসারী, গৃহ, ধনী, কাঙ্গালী সকলেই পৌষ-পার্বণ করিল, হেমলতা পার্বণের দিন কি ইহজন্মে আর আসিবে?

নবকুমারের বিপুল সংসার। কাহারও কিছু ক্ষোভ নাই অভাব নাই, দুঃখ নাই সেই সংসারে স্নেহপালিতা একমাত্র দুহিতা বিষন্ন। বিপুল সংসারেও হেমলতা একাকিনী।

॥ সাত॥

 নরেন্দ্র অতিশয় সন্তরণপটু ছিলেন। সেই রাত্রিতে সন্তরণ দিয়া গঙ্গা পার হইয়া অপর পারে উপস্থিত হইলেন। সম্মুখে অনেক দূর পর্যন্ত কেবল বালুকা, তাহার পর কেবল অনন্তু প্রান্তর দেখা যাইতেছে। নরেন্দ্র সেই অন্ধকার নিশীথে সিক্তশরীর ও সিক্তবস্ত্রে সেই বালুকা-ক্ষেত্রে বিচরণ করিতে লাগিলেন।

 নরেন্দ্র গঙ্গার অপর পাশের দিকে দৃষ্টি করিলেন। অন্ধকারেও বীরনগরের শেতপ্রাসাদ ঈষৎ দৃষ্ট হইতেছে, নরেন্দ্র সেইদিকে দেখিলেন, আবার চক্ষু ফিরাইয়া বিচরণ করিতে লাগিলেন। আবার স্থির হইয়া সেইদিকে চাহিলেন। নিস্তব্ধ অন্ধকারে গঙ্গার কলকল শব্দ শুনা যাইতেছে, সময়ে সময়ে পেচকের ভীষণ রব শুনা যাইতেছে, আর এক একবার দূরে শৃগালের কোলাহল শ্রুত হইতেছে। নরেন্দ্র গঙ্গা দেখিতে ছিলেন না, নরেন্দ্র পেচক রা শৃগালের ধ্বনি শুনিতেছিলেন না, তিনি নিঃশব্দে অন্ধকারে বিচরণ করিতেছিলেন। অনেকক্ষণ পর আবার বীরনগরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ঘোর অন্ধকারে আর সে গৃহ দেখা যায় না। নরেন্দ্র একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ফিরিলেন। সম্মুখে যে পথ পাইলেন, সেইদিকে চলিলেন।

 কোথায় যাইতেছেন নরেন্দ্র জানেন না। উপরে অসীম গগন, নীচে অসীম প্রান্তর, নরেন্দ্রের চিন্তাও অসীম ও অনন্ত, নরেন্দ্র যেদিকে পাইলেন চলিলেন। পথ-পার্শ্বে বটবৃক্ষ হইতে নিশাচর পক্ষী নরেন্দ্রকে দেখিয়া কুলায় ছাড়িয়া পলায়ন করিল, নিশাবিহারী শৃগাল পাল নরেন্দ্রকে দেখিয়া চীৎকার করিতে লাগিল, নরেন্দ্র তাহা গ্রাহ্য করিলেন না।

 অনেক দূরে যাইয়া একটি গ্রামে আসিলেন। গ্রাম নিস্তব্ধ, সকলেই সুপ্ত। কৃষ্ণবর্ণ বৃক্ষশ্রেণীর নীচে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটীর দেখা যাইতেছে ও বৃক্ষপত্রমধ্যে কোন কোন স্থানে

১৯