পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জেলেখাও উঠিল, শয্যার দিকে আসিবার জন্যই উঠিল, কিন্তু ক্ষণেক স্থির হইয়া ভূমির দিকে স্থির-নয়নে চাহিয়া দাড়াইয়া রহিল। ক্ষণেক পর জেলেখা ধীরে ধীরে নরেন্দ্রের নিকট আসিয়া ক্ষতস্থান পরীক্ষা করিল। ক্ষত প্রায় আরাম হইয়াছে, জ্বরও গিয়াছে, কেরল শরীর দুর্বল। নরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া একদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। জেলেখার মূখ রঞ্জিত হইয়া উঠিল, শরীরের রক্ত বেগে ললাট, চক্ষু ও গণ্ডস্থল আরক্ত করিল।

 পূর্বেও এই গৃহ ও শয্যা দেখিয়া নরেন্দ্র অতিশয় বিস্মিত হইয়াছিলেন। আসিয়াছেন, কে তাহাকে আনিল, কে সেবা করিতেছে। জেলেখা ও মসরুর কথা শুনিয়া ভীত হইয়াছিলেন, এখন জেলেখার আচরণ দেখিয়া আরও বিস্মিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন,—“আমি কোথায় আছি,—এই কি বঙ্গদেশ,—আপনি কে,— আপনার নাম কি?”

 নিস্তব্ধ নিশাযোগে সহসা বজ্রধ্বনি হইলে লোকে যেরূপ চমকিত হয়, জেলেখা সহসা নরেন্দ্রের এই প্রথম কথা শুনিয়া সেইরূপ চমকিত হইল; কোন উত্তব না দিয়া ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম ওষ্ঠদ্বয়ে অঙ্গুলিস্থাপন করিল।

 নরেন্দ্র আবার বলিলেন-“আমি অসহায় ও নিরাশ্রয়। আমি কোথায় আছি, অনুগ্রহ করিয়া বলুন।”

 জেলেখা আবার ওষ্ঠে অঙ্গুলি স্থাপন করিয়া সহসা মুখ ফিরাইল। নরেন্দ্রনাথের বোধ হইল, যেন, তিনি জেলেখার উজ্জ্বল চক্ষুতে জল দেখিতে পাইলেন; কিছু বুঝিতে পারিলেন না, চিন্তা কবিতে করিতে আবার নিদ্রিত হইলেন।

॥ বার॥

 কয়েক দিবসের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ বিশেষ আরোগ্যলাভ করিলেন। কিন্তু শারীরিক আরোগ্যলাভ হইলে কি হইবে, অন্তঃকরণ চিন্তায় ক্লিষ্ট হইতে লাগিল। তাহার সেই ঘরে কেবল মসরুর বা জেলেখা ভিন্ন কেহ আইসে না, কেহই কথা কহে না, মসুরুরকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে হাসিয়া চলিয়া যায়, জেলেখা ওষ্ঠের উপর অঙ্গুলিস্থাপন করে, অথচ স্পষ্ট বোধ হয়, জেলেখা তাঁহার দুঃখে দুঃখিনী, তাহার বিপদে বিপদাপন্ন। নরেন্দ্রনাথ ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। তিনি কি বঙ্গদেশে আসিয়াছেন। সুলতান সুজা নরেন্দ্রনাথকে ভালবাসিতেন, সুলতনই কি স্বয়ং আজ্ঞা দিয়া নরেন্দ্রের পীড়ার সময় রাজমহলে আনাইয়াছেন? সম্ভব বটে, রাজ-অট্টালিকা না হইলে এরূপ বহুমূল্য দ্রব্য কোথায় সম্ভবে? কিন্তু সুজা কাশীর যুদ্ধে পরাস্ত

৩০