পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেখেন, যেন সম্মুখে কোন দ্রব্য দেখিতে পাইতেছেন, আবার পদসঞ্চারণ করিতে থাকেন। এক একবার মুখে ঈষৎ হাস্য লক্ষিত হয়, আবার বদনমণ্ডল কঠোর ভাব ধারণ করে, ললাট কুঞ্চিত হয়।

 একবার স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইয়া, একদিকে স্থিরদৃষ্টি করিয়া অর্ধস্ফুট বচনে বলিতে লাগিলেন,—“উজ্জ্বল মণিময় মুকুট, ময়ূর-সিংহাসন প্রশস্ত ভারতভূমি পিতার দুর্বল হস্ত হইতে স্খলিত হইতেছে। কে লইবে? দারা, সাবধান! তোমার সাহস আছে, বল আছে, কিন্তু আমিও দুর্বল হস্তে অসি ধারণ করি নাই, পথ ছাড়িয়া দাও, নচেৎ অসিহস্তে পথ পরিষ্কার করিব। তুমি আত্মাভিমানী, দর্পী, কিন্তু তোমা অপেক্ষা ভীষণ দর্প ও দৃঢ়তর ব্রত সহাস্য বদনের ভিতর লুক্কায়িত থাকে। মোরাদ! তুমি সাহসী বীর। সিংহাসনে বসিবে? তবে শূকর যেমন কর্দমে পড়ে, সেইরূপ তুমি ধরাতলে লুটাইয়া পড়িলে কেন? বন্যশূকরেরও তোমার ন্যায় সাহস আছে। অচেতন? কল্য যুদ্ধ হইবে, অদ্য বিলাসবিহ্বল? যত দিন আবশ্যক, তোমার দ্বারা আমার কার্যসিদ্ধি করিব, তাহার পর এইরূপ পদাঘাত করিয়া তোমাকে দূরে ফেলিয়া দিব। কল্য যুদ্ধ হইবে, ললাটের লিখন কি আছে? পিতার হস্ত হইতে রাজদণ্ড কাড়িয়া লইতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, ভ্রাতার শোণিতে দেশ প্লাবিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। ভীষণ উদ্যমে প্রবৃত্ত হইয়াছি, অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি, আর ফিরিবার উপায় নাই। হৃদয়! সাহসে নির্ভব কর, আরও অগ্রসর হইব। অসিহস্তে কণ্টকময় পথ পরিষ্কার করিব, আবশ্যক হয়, উজ্জয়িনী হইতে আগ্রা পর্যন্ত পথ নর রক্তে রঞ্জিত করিব, কিন্তু এ ভীষণ প্রতিজ্ঞা বিচলিত হইবে না। পিতামহ তৈমুর। তোমার মুকুটে এই ললাট শোভিত করিব, নচেৎ কল্য হৃদয়শোণিতে সিপ্রাবারি রঞ্জিত করিব।”

সতের

  ১৬৫৮ খৃঃ অব্দে বৈশাখ মাসে ভীষণ যুদ্ধ হইল। মোরাদ ও আওরংজীবের সৈন্যেরা সিপ্রা নদী পার হইবার উদ্যম করিতে লাগিল, কিন্তু সে বড় সহজ ব্যাপার নহে। আওরংজীব সৈন্য পার হইবার জন্য অতিশয় নিপুণ ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। উন্নত স্থানে তাঁহার কামান সাজাইয়া, সম্মুখে শত্রুর আগমন রোধ করিয়া নিজ সৈন্যকে নদী পার হইতে বলিলেন। শত্রুরাও কামান সাজাইয়াছিল তদ্দ্বারা আওরংজীবের সৈনের নদী পার হওয়া নিবারণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, অনেকক্ষণ তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল। যশোবন্তসিংহ অপূর্ব বীর্যবল প্রকাশ করিয়া মোগলদিগের গতিরোধ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাঁহার সহযোদ্ধা কাসেম খা ঁসেরূপ যত্ন করিলেন না। তাৎকালিক

৪৮