পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লেখকেরা সন্দেহ করেন যে, তিনি আওরংজীবের অর্থে বশীভূত হইয়া আপন গোলা ও বারুদ লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার সৈন্যের কামান অচিরাৎ নিস্তব্ধ হইল। এ অবস্থায় শত্রুর কামানের সম্মুখে যুদ্ধ করা যশোবন্তের পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়িল; কিন্তু তিনি ভগ্নপ্রযত্ন না হইয়া অমানুষিক বীরত্ব প্রকাশপূর্বক শত্রুদিগের গতিরোধ করিতে লাগিলেন। সেখান পর্বতময়; সুতরাং আক্রমণকারিগণ সহজে নদী পার হইতে পারিল না, কিন্তু সাহসী মোরাদ কতিপয় সৈন্য লইয়া সকল ব্যাঘাত অতিক্রম করিয়া জয় জয় নাদে নদী পার হইলেন, তাহা দেখিয়া সমস্ত সৈন্য নদী পার হইল। ভীরু কাসেম খাঁ তৎক্ষণাৎ সসৈন্যে পলায়ন করিলেন, সুতরাং যশোবন্ত সিংহের বিপদসীমা রহিল না; কিন্তু সেই অসমসাহসী রাজপুত চতুর্দিকে শক্রবেষ্টিত হইয়াও তুমুল সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। তাঁহার সৈন্যসংখ্যা ক্ষীণ হইতে লাগিল, তাঁহার প্রিয় অনুচরেরা চতুর্দিকে হত হইতে লাগিল, মোগলেরা জয় জয় নাদে আকাশ ও মেদিনী কম্পিত করিতে লাগিল, তথাপি বীর রাজপুতেরা রণে ভঙ্গ দিল না। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর পরাস্ত হইয়া যশোবন্তসিংহ কেবলমাত্র পঞ্চ শত সেনা লইয়া যুদ্ধস্থল ত্যাগ করিলেন। সপ্ত সহস্র রাজপুত সেইদিন সেই ভীষণ যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনদান করিল।

আঠার

 যশোবন্তসিংহের অবশিষ্ট অল্পসংখ্যক সেনা রাজপুতানা অভিমুখে আসিতে লাগিল। নরেন্দ্র তাঁহার পরম বন্ধু গজপতির মরণে অতিশয় দুঃখিত ও ক্লিষ্ট হইলেন, কিন্তু প্রত্যহ নূতন নূতন দেশ দেখিতে দেখিতে সে দুঃখ কিঞ্চিৎ পরিমাণে বিস্মৃত হইলেন। কয়েকদিন আসিতে আসিতে সৈন্যেরা অবশেষে রাজপুতানার অভ্যন্তরে আসিয়া পড়িল। যশোবন্তসিংহ মাড়ওয়ার দেশের রাজা, সে দেশে আসিতে হইলে মেওয়ার দেশের অভ্যন্তর দিয়া আসিতে হয়।

 মেওয়ার দেশের অসংখ্য দুর্গ দেখিয়া নরেন্দ্র বিস্মিত হইলেন। দুর্গগুলি প্রায়ই পর্বতচূড়ায় নির্মিত, সহসা হস্তগত করা শত্রুর দুঃসাধ্য। পর্বতগুলি উন্নত শিরে মুকুটস্বরূপ দুর্গ ধারণ করিয়া অপুর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। সে সমস্ত দুর্গে উঠিবার পথ নাই, কেবল একদিকে সোপানের ন্যায় পথ আছে, তাহার উপর দিয়া লোক গমনাগমন করে। যুদ্ধকালে দুর্গের ভিতর খাদ্যসামগ্রী সঞ্চিত হয়, সেই একটিমাত্র দ্বার রুদ্ধ হয়, পরে শত্রুগণ যাহাই করুক না, দুর্গবাসিগণ নিশ্চিন্তে থাকিতে পারে।

 শত্রুরা দুর্গে উঠিবার উপক্রম করিলে উপর হইতে প্রস্তররাশি নিক্ষিপ্ত হয়, ঐ প্রস্তরাঘাতে একেবারে বহুসংখ্যক শত্রু বিনষ্ট হয়।

৪৯

 মাধবীকঙ্কণ—৪