পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সুখে নিদ্রা যাইতেছে। জগতে তাহাদের নাম নাই, বীরমণ্ডলীর মধ্যে তাহাদের স্থান নাই।”

উনিশ

 পরদিন প্রাতে নরেন্দ্র অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন, উক্ত চারণ শৈশবে মেওয়ারাধিপতি প্রতাপসিংহের দ্বারা প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। বাল্যকালাবধি চারণ প্রতাপের সঙ্গে সঙ্গে পর্বতগুহা ও উপত্যকায় কবিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন।

 দিল্লীশ্বরের সহিত অসংখ্য সংগ্রামের পর প্রতাপের যখন কাল হইল তখন চারণের বয়ঃক্রম বিংশ বৎসর। সে আজ ষাট বছরের কথা, সুতরাং চারণের বয়ঃক্রম এক্ষণে প্রায় অশীতি বৎসর। তথাপি চারণ এখনও চিতোরের পর্বত-দুর্গে রজনীতে বিচরণ করেন সকলে বলে, চারণ দেববলে বলিষ্ঠ।

 প্রতাপের মৃত্যু সময়ে তিনি মৃত্যুশয্যার নিকটে পুত্র অমরসিংহকে আনিয়া শপথ করাইয়াছিলেন যে তিনিও পিতার ন্যায় চিরকাল মোঘলদিগের সহিত যুদ্ধ করিবেন, অধীনতা স্বীকার করিবেন না। পিত্রাজ্ঞাপালনের জন্য অমরসিংহ অনেক বৎসর পর্যন্ত আকবর ও তাহার পুত্র জাহাঙ্গীরের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন ও পিতার ন্যায় বীরত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এই সকল যুদ্ধে চারণ সর্বদাই তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন ও সর্বসময়ে পিতার দৃষ্টান্ত দেখাইয়া উত্তেজিত করিতেন। কিন্তু সে উত্তেজনা বিফল, শেষে অমরসিংহ জাহাঙ্গীরের অধীনতা স্বীকার করিলেন। কিন্তু সে নামমাত্র অধীনতা তিনিই স্বদেশের রাজা রহিলেন, দিল্লীতে যে কর পাঠাইতেন তাহা দ্বিগুণ করিয়া সম্রাট তাহাকে ফিরাইয়া দিতেন। অমরসিংহকে দিল্লী যাইতে হইত না তাহার পুত্র করুণ ও পৌত্র জগৎসিংহকে জাহাঙ্গীর তাঁহার মহিষী নূরজাহান সর্বদাই সমাদরের সহিত আহ্বান করিতেন ও অনেক মণিমুক্তা দিয়া পরিতুষ্ট করিতেন। ইহাকে প্রকৃত অধীনতা বলে না, তথাপি চারণ রোষে ও অভিমানে অমরসিংহকে রাজা জ্ঞান না করিয়া অনেক কটূক্তি করিয়া প্রস্থান করিলেন। অমবসিংহও লজ্জিত হইলেন এবং পিতার নিকট যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন তাহা স্মরণ করিয়া রাজগদী ত্যাগ করিলেন; করুণ রাজা হইলেন।

 আকবর কর্তৃক চিতোর ধ্বংস হওয়ার পরই উদয়পুর নামে এক সুন্দর রাজধানী নির্মিত হইয়াছিল। কিন্তু চারণ ভগ্ন চিতোরদুর্গে বাস করিতে লাগিলেন, একদিন দু'দিন অন্তর দুর্গ হইতে অবতরণ করিতেন, নীচে পল্লী-গ্রামবাসীরা যাহা দিত, তাহাই খাইতেন, আবার দুর্গে আরোহণ করিয়া থাকিতেন। এইরূপে নির্জনে বাস করিয়া চারণ উন্মত্ত হইয়া গিয়াছেন। পর্বতগহ্বর তাঁহার বাসস্থান হইয়াছে, মেঘগর্জন ও ঝটিকায়

৫৩