পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহা হইলে গাঁথাইয়া হেমের গলায় পরায়। ঐ দেখ, চাঁদ উঠিবার আগে কেমন রাঙা হইয়াছে। ও আলো কোথা হইতে আসিতেছে। বোধ হয়, নদী পার হইয়া খানিক যাইলে ঐ আলো ধরা যায়। না, তাহা হইলে ওপারের লোক ধরিত। বোধ হয়, নৌকা করিয়া অনেক দূর যাইতে যাইতে চাঁদ যে দেশে উঠে, তথায় যাওয়া যায়; সে দেশে কি রকম লোক, দেখিতে ইচ্ছা করে। নরেন্দ্র বড় হইলে একবার যাবে, হেম, তুমি সঙ্গে যেও।

 বালক-বালিকা কথা কহিতে থাকুক, আমরা এই অবসরে তাহাদের পরিচয় দিব। এই সংসারে বয়োবৃদ্ধ বালক-বালিকারা গঙ্গার বালুকার ন্যায় ছার বিষয় লইয়া কিরূপ কলহ করে, চন্দ্রালোকের ন্যায় বৃথা আশার অনুগমন করিয়া কোথায় যাইয়া পড়ে, তাহারই পরিচয় দিব। পরিচয়ে আবশ্যক কি? পাঠক, চারিদিকে চাহিয়া দেখ, জগতের বৃহৎ নাট্যশালায় কেমন লোক-সমারোহ, সকলেই কেমন নিজ নিজ উদ্দেশ্যে ধাবমান হইতেছে। কে বলিবে কি জন্য?

দুই

 নরেন্দ্রনাথের পিতা বীরেন্দ্রনাথ দত্ত ধনাঢ্য ও প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তিনি নিজ গ্রামে প্রকাণ্ড অট্টালিকা নির্মাণ করাইয়া আপন নামানুসারে গ্রামের নাম বীরনগর রাখিয়াছিলেন। তাঁহার যথার্থ সহৃদয়তার অন্য সকলে তাঁহাকে মান্য করিত, তাঁহার প্রবল প্রতাপের জন্য সকলে তাঁহাকে ভয় করিত, পাঠান-জায়গীরদারগণ ও স্বয়ং সুবাদার তাঁহাকে সম্মান করিতেন।

 বাল্যকালে বীরেন্দ্র নবকুমার মিত্র নামক একটি দরিদ্র-পুত্রের সহিত একত্রে পাঠশালায় পাঠ করিতেন। নবকুমার অতিশয় সুশীল ও নম্র ও সর্বদাই তেজস্বী, বীরেন্দ্রের বশংবদ হইয়া থাকিত, সুতরাং তাহার প্রতি বীরেন্দ্রের স্নেহ জন্মিয়াছিল। যৌবনকালে যখন বীরেন্দ্র জমিদারি স্থাপন করিলেন, নবকুমারকে ডাকাইয়া আপনার অমাত্য ও দেওয়ান-পদে নিযুক্ত করিলেন। নবকুমার অতিশয় বুদ্ধিমান ও সুচতুর, সুশৃঙ্খলরূপে কার্য-নির্বাহ করিতে লাগিলেন। নবকুমার স্বার্থপর হইলেও নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, বীরেন্দ্রের নিকট ভিক্ষা করিয়া দুইখানি গ্রাম আপনার নামে করিলেন, কিন্তু ভয়ে হউক, কৃতজ্ঞতাবশতঃ হউক, বীরেন্দ্রের জমিদারির কোনও হানি করেন নাই। বীরেন্দ্রের মৃত্যুর সময়ে নরেন্দ্র অতি শিশু, জমিদারি ও পুত্রের ভার প্রিয় সুহৃদের হস্তে ন্যস্ত করিয়া বীরেন্দ্র মানবলীলা সংবরণ করিলেন।

 ভালবাসা যতদূর নামে ততদূর উঠে না, অপত্যস্নেহের ন্যায় পিতৃস্নেহ বা মাতৃস্নেহ