পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিস্মৃত হইয়াছে। আমি অবলা, আমার বল নাই। ভগবান সহায় হও, পাপচিন্তা হৃদয় হইতে উৎপাটিত কর, অবলার যতদূর সাধ্য চেষ্টা করিবে।

 শৈবলিনীর অপরূপ স্নেহ ও প্রবোধবাক্যে হেমলতা ক্রমশ শান্তিলাভ করিল, হৃদয়ের প্রথম প্রেমস্বরূপ ভীষণ শেল উৎপাটিত হইল কিন্তু অনেক দিনে, অনেক চেষ্টায়, অনেক পরিশ্রমে সে ফললাভ হইল। সেই পরিশ্রম ও চেষ্টায় যৌবনের প্রফুল্লতা শুরু হইয়া অবয়বে চিন্তার রেখা অঙ্কিত হইল হেমলতা আজি আর দুঃখিনী নহে, কিন্তু স্বভাবত ধীর নম্র ও নতশির।

 এক্ষণে হেমলতা ও শৈবলিনী সর্বদাই নরেন্দ্রের কথা কহিত, বাল্যকাল হইতে শৈবলিনী নরেন্দ্রকে ভ্রাতা বলিত এখন যেমন তাহাকে ভ্রাতার স্বরূপ জ্ঞান করিত। ভ্রাতার বিপদে বা অবর্তমানে ভগিনীর চিন্তা হয়, হেমও নরেন্দ্রের জন্য ভাবিত, কিন্তু তাহার হৃদয় আর পূর্ববৎ বিচলিত হইত না; কিম্বা যদি কখন কখন সায়ংকালে এই উপবনে একাকিনী বিচরণ করিতে করিতে হেমের বাল্যকালের কথা মনে পড়িত, ভাগীরথীর কলকল শব্দ শুনিয়া নীল গগনমণ্ডলে উজ্জ্বল পূর্ণচন্দ্র দর্শন করিয়া, শীতল হরি কুঞ্জবনে উপবেশন করিয়া বাল্যকালে সঙ্গীত-কথা মনে পডিত, যদি সে কথা মনে পড়িয়া হেমের চক্ষে একবিন্দু জল লক্ষিত হইত,—পাঠক, তাহার ভ্রাতৃস্নেহের নিদর্শন স্বরূপ বলিয়া মার্জনা করিও। অন্য ভাব তিরোহিত করিবার জন্য হেম অনেক চেষ্টা করিয়াছে, অনেক সহ্য করিয়াছে, অভাগিনী অনেক কাঁদিয়াছে, সে ভাব তিরোহিত হইয়াছে, যদি হৃদয়ের কন্দরে অজ্ঞাতরূপে সে ভাবের একবিন্দুও লুক্কায়িত থাকে, পাঠক, সেটুকু অভাগিনী হেমকে ক্ষমা করিও।

ঊনত্রিশ

 ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমলতা ও শৈবলিনী গৃহের সমস্ত কার্যাদি সমাপন করিল। পরে দুইজনে একটি ঘরে বসিলে হেম বলিল, “দিদি। অনেকদিন অবধি গল্প শুনি নাই, আজ একটু অবসর আছে, একটি গল্প বল।”

 শৈবলিনী সস্নেহ বচনে উত্তর দিল, “বলিব বৈকি বৌ, কোন্ গল্পটি বলিব বল।”

 হেম বলিল “রাজা হরিশ্চন্দ্রের গল্প অনেকদিন শুনি নাই, সেই গল্প বল।”

 শৈবলিনী হরিশ্চন্দ্রের গল্প বলিতে লাগিল। মহাভারতের কথা যথার্থই অমৃতের তুল্য, তাহার গল্প কী মিষ্টি, কী সুললিত, কী হৃদয়গ্রাহী। রাজার রাজ্য গেল, ধন গেল, মান গেল, স্ত্রী পুত্র লইয়া রাজা বনে বনে বিচরণ করিতে লাগিলেন। রাজমহিষী শৈব্যা এক্ষণে বাজার একমাত্র রত্ন। সুখের সময়, সম্পদের সময়, রমণী

৮৮