পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাঁহাদিগের মধ্যে একজন রাজার উপরোধে শ্রীশ সেই রাজার পরিবারের সহিত আপন পরিবারকে নওরোজার দিন প্রাসাদে পাঠাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। হেমলতা অগত্যা রাজপুত-মহিলার বেশ ধরিয়া রাজপুত রমণীদিগের সহিত আগ্রার বেগমমহলে গিয়াছিলেন।

একত্রিশ

 নরেন্দ্র আগ্রা-দুর্গের ভিতরে দর্পণে হেমলতার মুখচ্ছবি দেখিয়া প্রায় হতজ্ঞান হইয়াছিলেন, তাহা আমরা পূর্বেই বলিয়াছি। অনেকক্ষণ পরে নিস্তব্ধ আকাশ ও শান্ত-প্রবাহিনী নদীর দিকে চাহিতে চাহিতে ধীরে ধীরে আপন গৃহে যাইলেন।

 নরেন্দ্র গৃহে প্রবেশ করিলেন, একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে লোক কেহ নাই। নরেন্দ্র দ্বার রুদ্ধ করিয়া স্ত্রীলোকের বস্ত্র খুলিতে লাগিলেন। সহসা তাঁহার বক্ষস্থল হইতে একখানি পত্র ভূমিতে পড়িয়া যাইল, নরেন্দ্র দেখিলেন ইহা উর্দু ভাষায় লিখিত। নরেন্দ্র প্রদীপের নিকট বসিয়া পত্র খুলিয়া পড়িতে লাগিলেন। অধিক না পড়িতে পড়িতে বুঝিতে পারিলেন, জেলেখার পত্র। তখন অধিকতর বিস্মিত হইয়া আরও পড়িতে লাগিলেন। পত্রে এইরূপ লেখা ছিল:

 “নরেন্দ্র!

 আমি পাগলিনী, আমি হতভাগিনী, সেইজন্য এই পত্র লিখিতেছি। আমি চক্ষুতে আর দেখিতে পাইতেছি না, আমার মস্তক ঘুরিতেছে, তথাপি মৃত্যুর পূর্বে একবার মনের কথা তোমাকে বলিয়া যাই। তুমি যখন এই পত্র পড়িবে, তখন অভাগিনী আর এ জগতে থাকিবে না।

 আমি সাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা জেহান-আরা বেগমের পরিচারিকা। যেদিন বারাণসীর যুদ্ধ হয়, কার্যবশতঃ আমি ও মসরুর নামক খোজা রাজা জয়সিংহের শিবিরে ছিলাম। যেইদিন আহত ও অচেতন হইয়া তুমি সেই শিবিরে আনীত হও, সেইদিন তোমাকে দর্শন করিয়া হৃদয়ে কালসর্প ধারণ করিলাম।

 দিনে দিনে, সপ্তাহে সপ্তাহে, আমি হলাহল পান করিতে লাগিলাম। অশ্রান্ত হইয়া সেই পীড়াশয্যার উপর নত হইয়া থাকিতাম, অনিদ্রিত হইয়া সেই নিদ্রিত কলেবর নিরীক্ষণ করিতাম। ঐ প্রশস্ত ললাট ঐ রক্তবর্ণ ওষ্ঠ দুটির দিকে দেখিতাম আর পাগলিনী প্রায় হইতাম। পীড়াবশত যখন তুমি আমাকে লক্ষ্য করিয়া তিরস্কার করিতে, আমি নিঃশব্দে মনের দুঃখে রোদন করিতাম। পীড়াবশত যখন সস্নেহে আমার

৯২