পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ব-নির্বাচিত গল্প.pdf/১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বৃহত্তর—মহত্তর

 নারী-সমিতিটির খোঁজ করে সম্পাদিকার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি জানালেন মমতাদি মাঝে একমাস জেল খেটেছে এবং আবার জেলে যাবার জন্য বাড়াবাড়ি আরম্ভ করায় তাকে মফস্বলে কাজ করতে পাঠান হয়েছে। এই সমিতির কাজ গঠনমূলক, ধ্বংস এর কর্মীদের ব্রত নয়, মমতাদিকে নিয়ে সম্পাদিকার বড় মুশকিল।

 পরদিন আমি মমতাদি যে গ্রামে ছিল সেখানে গেলাম। কলকাতা থেকে চাৱ পাঁচ ঘণ্টার পথ।

 বেশ বড় গ্রাম। গ্রামের পাশে একটা নদী। খোঁজ করে, শোভার প্রাচুর্যে নদীতীর যেখানে আপনাতে আপনি মুগ্ধ হয়ে আছে, সেইখানে একটি ছোট টিনের বাড়িতে মমতাদির দেখা পেলাম। মমতাদি এবং তার সঙ্গিনীদের জন্য গ্রামের কে এক সদাশয় ব্যক্তি এই বাড়িখানা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

 তখন দুপুর। শরতের প্রথম হলেও রোদের তেজ ছিল। সদরের বারান্দায় উঠে দাঁড়াতে চার পাঁচটি চরকার শব্দ শুনতে পেলাম। মমতাদিকে ডাকতে চরকা থেমে গেল, সে বেরিয়ে এল।

 হেসে বলল, এসেচ? আমি জানতাম খোঁজ পেলে তুমি আসবেই, দু’এক ঘণ্টা তর্ক করবেই। তোমার প্রতীক্ষা করছিলাম আমি।

 তর্ক করব নিশ্চিত জান?

 জানি। যে কাণ্ড করেচি, তর্ক না করে তুমি ছাড়বে?

 যদি না করি তর্ক?

 বিস্মিত হব। ভেবে পাব না বাঙ্গালী হয়েও তর্কের এমন সুযোগ কি করে ত্যাগ করলে। কিন্তু তুমি করবে। তোমার চোখে-মুখে তর্ক উঁকি মারচে। অন্ততঃ আলোচনা।

 নদীতে নেমে মুখ হাত ধুয়ে আমি বারান্দায় মাদুরে বসলাম। সেও বসল———অর্ধেক মাদুরে অর্ধেক মাটিতে। মেয়েরা অমনি ভাবে বসে, বিনয়ের লক্ষণ ওটা। কথা আরম্ভ হওয়ার আগে আমি একবার ভাল করে তার মুখ দেখে বুঝবার চেষ্টা করলাম, এজীবনে সে সুখী হয়েছে কিনা। কিছুই স্পষ্ট বোঝা গেল না। আগের জীবনে সে অসুখী ছিল, কিন্তু মুখের একটু ম্লানিমা দেখে তার অসুখের পরিমাণ স্থির করা যেমন সম্ভব ছিল না, আজ সেই ম্লানিমার অন্তৰ্ধান এবং দেহে স্বাস্থ্য ও চোখে-মুখে একটা শান্ত-জ্যোতির আবির্ভাব দেখে

● স্ব-নির্বাচিত গল্প ●