পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ব-নির্বাচিত গল্প.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বৃহত্তর—মহত্তর

বোঝা গেল না সে কতখানি সুখী হয়েছে। বিশেষ, মাঝে মাঝে তার দৃষ্টিতে ব্যথার বিকাশ দেখা যেতে লাগল।

 সে প্রশ্ন করল, তুমি কি আমাকে সমর্থন কর না?

 আমি বললাম, ঠিক জানি না। ইচ্ছা হয় সমর্থন করি, কিন্তু বাধা পাই। তোমার সিদ্ধান্তে অনেক জটিলতা, সহজে মেনে নেওয়া কঠিন। তোমায় আমি চোখ বুজে সমর্থন করতাম। যদি——

 ঘদি?

 যদি তোমার দেশ-প্রেম নিজের তেজে স্বামিপুত্রের প্রেমকে ছাপিয়ে যেত, যদি রাগ আর অভিমানের ভেজাল না থাকত।

 সে হাসল! বলল, তাপসী নই, মন নির্বিকার নয়। ভেজাল হয়ত আছে। কিন্তু তুমি যে রাগ আর অভিমানের কথা ভাবচ তার ভেজাল নেই। তুমি ভাবচ আমি ঝগড়া করে ঝোঁকের মাথায় চ’লে এসেচি। তা সত্যি নয়। সে ভয় আমারও ছিল। কতদিন ধরে চেষ্টা করে আমি বাড়ি ছাড়তে পেরেছি জান? ছ’সাত মাসের বেশী। রাগের মাথায় চলে এসোচি ভেবে পরে পাছে আমার অনুতাপ হয় এই ভয়ে যখনি সে বেশী রকম খারাপ ব্যবহার করত আমি গৃহত্যাগের সময় পনরো দিন পিছিয়ে দিতাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে অন্ততঃ পনরোটা দিন যখন রাগের কোন কারণ উপস্থিত হবে না। তখন বাড়ি ছাড়ব, তার আগে নয়। এই প্রতিজ্ঞা বজায় রাখতে গিয়ে, আসবার জন্য পা বাড়িয়ে থেকেও ছ’সাত মাস আসতে পারি নি। শেষের দিকে তা হতাশ হয়েই পড়েছিলাম যে একবারও খিটমিটি বাধবে না এমন পনরোটা দিন এ জীবনে আসবে না। কিন্তু হঠাৎ তার কঠিন অসুখ হল——

 সেই সুযোগে চলে এলে!

 সে হাসিল।———শোনই আগে, পরে মন্তব্য প্রকাশ করবে। তার ত অসুখ হল, আমি নাওয়া খাওয়া ঘুম সব ছেড়ে দিয়ে এমন সেবাটাই করলাম যে অসুখ ভাল হওয়ার সঙ্গে সেও কিছুকালের জন্য ভাল হয়ে গেল! ঠিক বিয়ের দিনগুলি যেন ফিরে এল———এত আদর, এত সোহাগ, এত ভালবাসা! পনরো দিন হঠাৎ সদয় অদৃষ্টের দান ভোগ করে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমি চলে এলাম। রাগ করে এসেচি আমি? ঝগড়া করে এসেচি? তা আর বলতে হয় না।

● মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ●