পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in S Oo মানিক রচনাসমগ্ৰ শীতলেব একটা ব্যবস্থা ? বিধানের পড়ার খরচ না দিক শীতলের জন্য রাখাল কিছু করিতে পারে না ? শীতল? রাখাল অবাক হইযা থাকে। শীতল চাকরি করিবে, ওই অসুস্থ আধপাগলা মানুষটা! কী বলছি বউঠান তুমি, তোমার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে ? আমার যে উপায় নেই। ঠাকুরজামাই ? শেষে রাখাল বলে, আচ্ছা দেখি। রাখাল সতাই চেষ্টা করিল। শীতল বহুকাল কলিকাতার প্রেসে বড়ো চাকরি করিয়াছে, এই সব বলিয়া কহিয়া বোধ হয় স্থানীয় একটা ক্ষুদ্র ছাপাখানায় একটা কাজ সে জোগাড়ও করিয়া ফেলিল শীতলের জন্য। বেতন পনেরো টাকা। কাজকর্ম দেখিবে, খাতপত্র লিখিবে, মফস্বলের ছোটো ছাপাখানা, কােজ সামান্যই হয়, শীতল পরিবে হয়তো। খবর শুনিয়া শীতল বিবর্ণ হইয়া বলিল, অসুখ যে আমার, আমি পারব কেন ? কলম ধরলে আমার যে হাত কঁপে, আমি যে লিখতে পারিনে রাখাল ? শ্যামা বলিল, আগে থেকে ভড়কাচ্ছ কেন বল তো? গিয়েই দ্যাখো না পার কিনা, দুদিন যেতে আরম্ভ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় পঞ্চাশ, কোথায় পনেরো। পঞ্চাশই বা কেন ? ছাপাখানায় কাজ করিয়া তিনশো টাকাও তো শীতল একদিন মাসে মাসে ঘর আনিয়াছে। তবে আজ সে কথা ভাবা মিছে। সেদিন আব্ব ফিরিবে: না, সে শীতল নাই, সে শ্যামাও নাই। পঞ্চাশ টাকার আশা করিয়া পনেরো টাকাতেই শ্যামা এখন খুশি হইতে জানে। শীতল আপিসে যায়। ছাপাখানা প্রায় আধ মাইল দূরে। স্নান করিয়া খাইয়া শীতল ছেড়া কোটটি গায়ে চাপায়, বিষগ্ন সকাতর মুখে হ্রকায় কয়েকটা শেষটান দিয়া মোটা লাঠিটি বাগাইয়া ধরে। বড়ো দুর্বল পা দুটি শীতলেব, লাঠিতে ভর দিয়া সে গুটিগুটি হাঁটিতে আরম্ভ করে। পোষা কুকুরটি তখন উঠিয়া দাঁড়ায়, লেজ নাড়িতে নাড়িতে সে শীতলের সঙ্গে যায়। পুকুর ঘুরিয়া গলি পথ পার হইয়া বডো সদর রাস্তা পর্যন্ত শীতলকে আগাইয়া দিয়া আসে। বকুল চিঠি লিখিয়াছে, সে ভালো আছে। বিধান চিঠি লিখিয়াছে, সেও ভালো আছে। সকলে ভালো আছে । শরীরটা শ্যামারও বহুকাল ভালোই আছে। দুবেলা রাধে, সংসারের কাজকর্ম করে, অবিশ্রাম খাটুনি শ্যামার, শক্ত সবল দেহ না থাকিলে কবে শ্যামা ক্ষযা হইয়া যাইত। এত খাটিতে হয় কেন শ্যামাকে ? আশ্রিতার সমস্ত অবসর মুহূর্তগুলো কেমন করিযী কর্তব্যে ভরিয়া ওঠে। কেহ টেরও পায় না। একদিন দেখা যায় ভোর পাঁচটা হইতে রাত এগারোটা অবধি যত কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব সব সে করিতেছে একা । কস্তাপাড় মোটা একখানা শাড়ি পরিয়া শ্যামা কাজ করে, দেখিয়া কে বলিবে সে এ বাড়ির দাসী নয়। হাতের চামড়া তাহার কর্কশ হইয়াছে, থাবা হইয়াছে বড়ো, আধমান জলের বালতি সে অবলীলাক্ৰমে তুলিয়া নেয়, গায়ে এত জোর। ছেলেমেয়েরা বড়ো হইয়াছে, রাত্রে তাহাকে বারবার উঠিতে হয় না, বিধানও এখানে নাই যে জাগিয়া বসিয়া সে তাহার পাঠরত পুত্রের দিকে চাহিয়া আকাশ-পাতাল ভাবিবে, কাজকর্ম শেষ করিয়া শোয়া-মাত্র শ্যাম ঘুমাইয়া পড়ে, কোথা দিয়া রাত কাটিয়া যায় সে টেরও পায় না। টাকার চিন্তা করে না শ্যাম ? শীতলের পনেরো টাকার চাকরিতেই সে নির্ভাবনা হইয়া গিয়াছে নাকি! চিন্তার তাহার শেষ নাই। তবে রাত জাগিয়া কোনো ভাবনাই সে ভাবিতে পারে না। সারাদিন সহস্র কাজের সঙ্গে ভাবনার কাজটাও সে করিয়া যায়, অনেকটা কলের মতে, পাঠাভ্যাসের মতো।