পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী >の> এমনই হইয়াছে আজকাল। আজীবন শ্যামা যে একা, কারও সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া ভাবিবার সুযোগ সে যে কোনোদিন পায় নাই, অতীতের স্মৃতিতে, বর্তমানের সম্পদে-বিপদে, ভবিষ্যতের জল্পনাকল্পনায় চিত্ত তাহার নিঃসঙ্গ, নির্ভরহীন। ফণী একবার নিউমোনিয়ায় মবমর হইয়া বঁচিয়া উঠিল, মন্দার যমজ ছেলে দুটির একজন, সে কালু, মরিল জ্বরবিকারে। পড়াশোনা ভাই দুটি বেশি দূর করে না, পাটের ব্যাবসা আরম্ভ করিয়াছিল। গতবছর একদিনে একলগ্নে দুভাইয়ের বিবাহ দিয়া মন্দা আনিয়াছিল দুটি বউ! শ্যামার জীবনে ওদের বিশেষ কোনো স্থান ছিল না, কালুর মরণ শ্যামার কাছে বিশেষ কিছু শোচনীয় ব্যাপার নয়, তবু সেও বিশেষ যেন গভীর শোক পাইল। মন খারাপ হইয়া যাওয়া আশ্চর্য ছিল না। মামি বলিয়া কোনোদিন খাতির না করুক, আশ্রিতা বলিয়া মাঝে মাঝে অপমানজনক ব্যবহার করুক, যত্ন করিয়া ওকে তো দুবেলা সে ভাত বাডিয়া দিয়াছে। কিন্তু এমন শোক কেন, পুত্ৰশোকের মতো ? কালুকে মনে করিয়া, কচি বউটাব বিধবার বেশ দেখিয়া, শ্যামার বুকের ভিতরটা পাক দিয়া যেন ভাঙিয়া যাইতে লাগিল, উন্মাদিনী মন্দাকে দুটি সবল বাহু দিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিয়া অসহ্য বেদনায় শ্যামাও অজস্র চোখের জল ফেলিল। কেন তার এই অস্বাভাবিক ব্যথা? পরে, মন্দার শোকও যখন শান্ত হইয়া আসিয়াছে, তখনও শ্যামা যেন অশান্ত হইয়া রহিল মনে মনে। রহস্যমােস মনোবেদনা নয়, সাময়িক মনোবিকার নয়, একটা দিনও যে হাসিয়া কথা বলে নাই সেই কালুর জন্য স্পষ্ট দুরন্ত জ্বালা! শ্যামার মতো কালুর বউও অল্প বয়সে বাপ-মাকে হারাইয়াছিল, হঠাৎ শ্যামা যেন তাব জন্য পাগল হইয়া উঠিল, নিজের মেয়েকেও সে বুঝি এত ভালো কখনও বাসে নাই। বউয়ের বিধবা বেশ মন্দা দেখিতে পারে না, নিজের শোক লইয়াই সে বিব্রত, বউ সামনে গেলে কখনও সে শাপিতে আরম্ভ করে, বউকে বলে মানুষখেকো রাস্ফুসি, আবার কখনও বুকে জড়াইয়া হাহা করিয়া কঁাদে, তারপরেই দূরদূর করিয়া তাড়াইয়া দেয়, চােখেব সামনে থেকে সরে যা তুই, সরে যা অলক্ষ্মী। শ্যামার মমতায় কালুর বউ বড়ো একটি আশ্রয় পাইল। শ্যামার প্রশস্ত বুকে মাথা রাখিয়া সজল চােখে সে ঘুমায়, জাগিয়া ওঠে শ্যামারই বুকে, সারারাত ঠায় একভাবে কাটাইয়া শ্যামার পিঠের মাংসপেশি খিচিযা ধরিয়াছে। তবু সে নড়ে নাই, কৰ্ণ যে ভাবে বজুকীটের কামড় সহিয়াছিল। তেমনিভাবে দেহের যাতনা সহিয়াছে,--নাড়িতে গেলে ঘুম ভাঙিয়া, বউ যদি আবার কঁদে ? কালুর জন্য শ্যামার শোক কেন বুঝিতে না পারা যাক, কালুর বউয়ের জন্য তার ভালোবাসা নিশ্চয় বকুলের বিরহ ? কিন্তু তা যদি হয় তবে কালুর জন্য শ্যামার এই শোক বিধানের বিরহ হইতে viši (NE ও সব নয়। আসলে শ্যামার মনটাই আলগা হইয়া আসিতেছে, পচিয়া যাইতেছে। গোড়াতে সাত বছর একদিকে পাগলা শীতলের সঙ্গে বাস করিতে কঁচা বয়সের মনটা তাহার কুঁকড়াইয়া গিয়াছিল অন্যদিকে ছিল মাতৃত্বলাভের প্রাণপণ প্রয়াসের ব্যর্থতা—দুটি একটি সঙগী অথবা আত্মীয়স্বজন থাকিলে যাহা তাহার এতটুকু ক্ষতি করিতে পারিত না কিন্তু এক পাইযা সাত বছরে যাহা তাহাকে প্রায় কাবু করিয়া আনিয়াছিল,—এতকাল পরে এখন, জীবন-যুদ্ধে পরিশ্রান্ত মনটাতে যখন তাহার। আর তেমন তেজ নাই, সেই অস্বাভাবিকতা, সেই বিকার অ আর অধিকার বিস্তার করিতেছে। মানুষ নয় শ্যামা ? জীবনের তিনভাগ কাটিয়া গেল, এর মধ্যে একদিন সে বিশ্রাম পাইয়াছে? দেহের বিশ্রাম নয়। দেহ তার ভালোই আছে, গর্ভের নবাগত সন্তানকে বহিয়া সে কাতর নয়। বিশ্রাম পায় নাই তার মন। এখন তাহার একটু সুখ শান্তি ও স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে বইকী। প্রসবের তিনদিন আগেও শ্যামা একা একশোজনের ভোজ রাধিয়া দিবে, শুধু পরের আশ্রয় হইতে এবার তাকে লইয়া চল, ভবিষ্যৎকে একটু নিবাপদ করিয়া দাও, আর ওষুধের মতো পথ্যের মতো একটু স্নেহদাও শ্যামাকে। একটু নিঃস্বর্থ অকারণ মমতা। Yx