পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী So কুড়ি-পাঁচশ ও যা পায় মাসিম, একজনের পক্ষে তাই ঢের। তাছাড়া এমন করে থাকার চেয়ে না খেয়ে মরাও ভালো। —-পুরুষমানুষ নয় ও ! রাগে বিভা গরগর করে। শ্যামা একটু অবাক হয়, এত রাগ কেন বিভাের? কোথায় কোনো কাপুরুষ যুবক ক্রীতদাসের জীবনযাপন করে খেয়াল করিয়া বিচলিত হওয়ার স্বভাব তো বিভার নয়! হঠাৎ বিভা করে কী, কুঁকিযা ডাক দেয়, বনুবাবু, মা আপনাকে ডাকছেন, উপরে আসবেন একবার? বনবিহারী মুখ তুলিয়া তাকায়, বলে, যাই। সে উঠিয়া আসিলে শ্যামাকে অবাক করিয়া দিয়া বিভা তাহাকে বকে। রীতিমতো ধমকায়। বলে, কী যে প্রবৃত্তি আপনাব বুঝিনে কিছু, একেবারে আপনার ব্যাকবোন নেই, সারাদিন ঘুরে এত রাত্রে ফিরে এলেন এখনও আপনাকে সংসারের কাজ করতে হবে? কেন করেন। আপনি ? আমি হলে তো সবাইকে চুলোয় যেতে বলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তাম, এত কী আহ্রদ সকলের ! বিনে মাইনের চাকর নাকি আপনি! - এমনিভাবে কত কথাই যে বিভা তাহাকে বলে। বলে সংসাবে এমন নিরীহ হইয়া থাকিলে চলে না। একটু শক্ত হইতে হয়। অপদার্থ জেলিফিশ তো নব্য বনবিহানী ! বলিতে বলিতে এত রাগিয়া ওঠে বিভা যে হঠাৎ মুখ ঘুরাইয়া গাঁটগট করিয়া সে ভিতরে চলিয়া যায। মুখ নিচু করিয়া বনবিহারী নামে নীচে। শ্যামা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিতে থাকে যে বিভা অনেকদিন এখানে আছে, বনবিহারীর সঙ্গে পরিচয়ও তাহার অনেকদিনের, বিভার গায়ে পড়িয়া বকবিকি করাটা যেমন বিসদৃশ শোনাইল আসলে হযতো তা তেমন খাপছাড়া নয়। এখানে আসিয়া অল্পে অল্পে শ্যামার মন কিছু সুস্থ হইযাছে। তবে শ্যামা আব্ব সে শ্যামা নাই। বনগাঁয়ে হঠাৎ সে যে রকম শান্ত ও নির্বাক হইয়া গিযাছিল, এখানেও সে প্রায় তেমনি হইয়া আছে, শুধু তার এই পরিবর্তন এখন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না। আসন্ন সন্তানসম্ভাবনার সঙ্গে পরিবর্তনটুকু খাপ খাইয়া গিয়াছে। চলাফেরা কাজকর্ম সমস্তই তার ধীবমস্থর, সংসারটাকে ঠেলিয়া তুলিবার জন্য তার ধৈর্যহীন উৎসাহ আর নাই, নিজের সংসারে থাকিবার সময় সে একদিন ছেলেমেয়ের জামার ছাটটি পদ্মান্তি ক্ৰমাগত উন্নততর করিতে না পারিলে স্বস্তি পাইত না, সংসাবেব তুচ্ছতম খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো পর্যন্ত তার কাছে ছিল গুরুতব, এখন সে শুধু মোটামুটি সংসাবটা চালাইয়া যায়, ছোটােখাটাে ত্রুটি ও ফাকি সে অবহেলা করে। সংসারের যেখানে বোতাম ছিড়িয়া ফাঁক বাহির হয় সেখানে সেফটিপিন গুজিয়া কাজ চালাইতে তাহার বাধে না । ছেলেদের জীবনের প্রত্যেকটি মিনিটের হিসাব রাখা আব্ব হইয়া ওঠে না, বিধান দেবি করিয়া বাড়ি ফিরিলে কারণ জিজ্ঞাসা করিতে সে ভুলিয়া যায়, শীতের সন্ধ্যায়। ফণীর পায়ে মোজা না উঠিলেও তার চলে। ঘরের আনাচে-কানাচে ধুলাবালি, জামাকাপড়ে ময়লা, চৌবাচ্চায় শ্যাওলা জমিতে পায়। নুতন যারা শ্যামাকে দেখিল তারা কিছু বুঝিতে পারে না, আগে যারা তাহাকে দেখিয়াছে তারাই শুধু টের পায় বনগা তাহাকে কী ভাবে বদলাইয়া দিয়াছে। আবার শীত শেষ হইয়া আসিল। ফাঙ্গুনমাসে একটি কন্যা জন্মিল শ্যামার। বকুল বুঝি আবার শুরু হইল গোড়া হইতে। কিন্তু বকুলের কী দুটি ডাগর চােখ ছিল। এ মেয়ের চােখ কোথায় ? হায়, শ্যামার মেয়ে জন্মিযাছে অন্ধ হইয়া। গর্ভের অনাদিকালের অন্ধকার তাকে ঘিরিয়া রহিল, এ জগতের আলো সে চিনিবে না কোনোদিন । জন্মান্ধ? কার পাপের ফল ভোগ করিতে তুই পৃথিবীতে আসিলি খুকি! দৃষ্টি তোর হরণ করিল কে? ভাবিতে ভাবিতে শ্যামা স্মরণ করে, বনগীয় একদিন সন্ধ্যার সময় কলাবাগানে