পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in >のbr মানিক রচনাসমগ্ৰ ছায়ার মতো কী যেন দেখিয়া তার গা ছমছম করিয়াছিল, স্নানের আগে এলোচুলে তেল মাখিবার সময় আর একদিন পাগলা হাবুর বুড়ি দিদিমা তাহাকে দেখিয়া ফেলিয়াছিল, অজ্ঞাতসারে আরও কবে কী ঘটিয়াছিল কে জানে! কী আর করা যায়, অন্ধ মেয়েকে শ্যামা সমান আদরেই মানুষ করে, যেমন সে করিয়াছিল বকুলকে, যার ডাগর দুটি চোখ শ্যামাকে অবিরত অবাক করিয়া রাখিত। দুমাস বয়স হইতে না হইতে শীতল মেয়েকে বড়ো ভালোবাসিল। বিধান একটা ঠাকুর আনিয়াছিল, তাহাকে ছাড়াইয়া দিয়া শ্যামা আবার রান্না আরম্ভ করিলে মেয়ে কোলে করিয়া বসিয়া থাকার কাজটা পাইয়া শীতল ভারী খুশি। এখানে আসিয়া বনগাঁর পোষা কুকুরটির জন্য শীতলের মন-কেমন করিত, খুকিকে কোলে পাইয়া কুকুরের শোক সে ভুলিয়া গেল। শীতলের বাঁ-পায়ের বেদনােটা আবার চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। এ জন্য দোষী করে সে শ্যামাকে। শ্যামার জন্যই তো চাকরি করিতে দুর্বল পা লইয়া দুবেলা তাহাকে হাঁটাহাঁটি করিতে হইত বনগাঁয়! অবসর সময়টা শ্যামা তার পায়ে তপিন তেল মালিশ করিয়া দেয়। অসুস্থ স্বামীকে চাকরি করিতে পাঠাইয়া অপরাধ যদি তার হইয়া থাকে, এ তার অযোগ্য প্ৰায়শ্চিত্ত নয়। মোহিনী কলিকাতায় চাকরি করে কিন্তু শ্বশুরবাড়ি বেশি সে আসে না, বোধ হয় পিসির বারণ আছে। শ্যামা তাকে দুদিন নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিল, দুদিন আসিয়া সে খাইয়া গিযাছে, নিজে হইতে একদিনও খোঁজখবর নেয় নাই। বিধান প্রথম-প্রথম কাকার বাড়ি গিয়া মোহিনীর সঙ্গে সর্বদা দেখা সাক্ষাৎ করিত, এখন সেও আর যায় না। রাগ করিয়া শ্যামাকে সে বলে, এমনি লাজুক হলে কী হবে, মোহিনী বড়ো অহংকারী মা-কতবার গিয়েছি আমি, কত বলেছি আসতে, এল একবার গ নেমন্তয় না করলে বাবুর আসা হয় না, ভারী জামাই আমার! —এদিকে তো মাছিমারা কেবানি পোস্টাপিসের ! কিন্তু মোহিনী একদিন বিনা আহ্বানেই আসিল। লজ্জায় মুখ রাঙা করিয়া বিধানের কাছে সে স্বীকার করিল যে বকুলের চিঠি পাইয়া সে আসিয়াছে। বকুলকে এখন একবাব আনা দরকাব। পনেরো দিনের ছুটি লইয়া সে বাড়ি যাইতেছে, ইতিমধ্যে শ্যামা যদি তাহার পিসিকে একখানা চিঠি লিখিযা দেয়। আর চিঠির জবাব আসাব আগেই বিধান যদি সেখানে গিয়া পড়ে, বকুলকে পাঠানোর একটা ব্যবস্থা মোহিনী। তবে করিতে পারে। মোহিনীর কথাবার্তা বিধানের কাছে হেঁয়ালির মতো লাগে, সে বলে বোসো তুমি, মাকে বলি। মোহিনী বলে, না না, আমি গেলে বলবেন। কিন্তু তা হয় না, শ্যামাকে না বলিলে এ সব সাংসারিক ঘোর-প্যাচ কে বুঝিতে পরিবে? বিধান শ্যামাকে সব শোনায়। শুনিবা মাত্র ব্যাপার আঁচ করিয়া শান্ত নির্বক শ্যামার সহসা আজ দেখা দেয় অসাধারণ ব্যস্ততা । কই মোহিনী ? ডাক খোকা, মোহিনীকে ডাক। শ্যামার চোখ ছলছল করে। আনিবার জন্য তাই বকুল ইদানীং এত করিয়া লিখিতেছিল! তারা আনিবার ব্যবস্থা করিতে পারে নাই বলিয়া মেয়ে তার জামাইকে এমন চিঠি লিখিয়াছে যে, বিনা নিমন্ত্রণে যে কখনও আসে না সে যাচিয়া আসিয়াছে বকুলকে আনানোর যড়যন্ত্র করিতে, ছুটি লইয়া যাইতেছে বাড়ি! মোহিনীকে কত জেরাই যে শ্যামা করে! সজল চোখে কতবার যে সে মোহিনীকে মনে করাইয়া দেয়। তার হাতে যেদিন মেয়েকে সঁপিয়া দিয়াছিল। সেইদিন হইতে শ্যামার ছেলের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য নাই, বিধান যেমন মোহিনীও তেমনি শ্যামার কাছে। অনুযোগ দিয়া বলে, তোমারি বাড়ির কারুর কি উচিত ছিল না বাবা এ কথাটা আমায় লিখে জানায়!