পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in δ Σ. Ν. মানিক রচনাসমগ্ৰ বিভা বিব্রত হইয়া থাকে। বনবিহারী এমন নিরীহ, যত স্পষ্টই হােক এমন মুক ও নিস্ক্রিয় তার প্রেম, তার বিরুদ্ধে নালিশ খাড়া করিবার তুচ্ছতম প্রমাণটিরও এমন অভাব যে এ বিষয়ে সকলের যেমন তারও তেমনি কিছু বলিবার অথবা করিবার উপায় নাই। মনে মনে সে কখনও রাগে কখনও বোধ করে মমতা ; সিঁড়ি দিয়া নামার সময় কোনোদিন তাকায় ক্রুদ্ধ ভৎসনার চোখে কোনোদিন দুটি-একটি স্নিগ্ধ কথা বলে। ভালো যে লাগে না একেবারে তা নয়। একটা কুকুরও কুকুরের মতো পোষ মানিলে মানুষের তাতে কত গর্ব কত আনন্দ, এ তো একটা মানুষ অথচ এ রকম পুজা গ্রহণ করিবার উপায় না থাকিলে কী বিশ্ৰীই যে লাগে মানুষের, মনে যার একফোটা দয়ামায়া থাকে। বকুলের সঙ্গে হাসাহাসি করে বটে, মনে মনে শ্যামা কিন্তু ব্যথা পায়। শক্তসমর্থ যুবক, এ কী ব্যাধি তার মনের! মেরুদণ্ডটা পর্যন্ত যে ওর গলিয়া গেল, সুযোগ পাইয়া কী ব্যবহারটাই বাড়ির লোকে করে ওর সঙ্গে, নিজের মনুষ্যত্ব যে বিসর্জন দিয়াছে কে তাকে মানুষ জ্ঞান করিবে, দোষ কারও নাই। আচ্ছা, শামুর জন্য বিধানও যদি আমনি হইয়া যায়? আমনি উন্মাদ ? ও ভগবান, শ্যামা। তবে নিজেই পাগল হইয়া যাইবে! অনেক ভাবিয়া শ্যামা শেষে একদিন বকুলকে বলে, শোন খুকি। বলি, দ্যাখ শামুকে যদি খোকার পছন্দ হয়ে থাকে, ওর সঙেগই না হয় দিই খোকার বিয়ে ? স্বঘর তো, দোষ কী!! বকুল স্তম্ভিত হইয়া যায়, বলে খেপেছ নাকি তুমি মা, কী বলছি তার ঠিকাঠিকানা নেই, ওই মেয়ের সঙ্গে তুমি বিয়ে দিতে চাও দাদার! শামু ভালো নয়। মা-শয়তানের একশেষ। এমন কথা মনেও ঠাই দিও না। কী হইবে তবে? একদিন শামু না আসিলে বিধান যে উশখুশ করিতে থাকে। শামুর হাসির হিল্লোলে সংসার যে শ্যামার ভাসিয়া যাইতে বসিয়াছে! ভগবান মুখ তুলিলেন। १ অনেক দুঃখ শ্যামা পাইয়াছে, আর কী তিনি তাকে কষ্ট দিতে পারেন। একদিন বিধান বলিল, শঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম মা, আমাদের বাড়িটা দেখে আসতে ইচ্ছে হল, গিয়ে দেখি ভাড়ার নোটিশ ঝুলছে। যাবে ও বাড়িতে ? আমাদের বাড়ি!! আজিও সে বাড়ির কথা বলিতে ইহারা বলে আমাদের বাড়ি! শ্যামা সাগ্রহে বলিল, সত্যি খোকা ?--যাব, চল সামনের মাসেই আমরা চলে যাই, পয়লা তারিখে। সামনের মাসে পয়লা তারিখে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহারা বাড়ি বদলাইয়া ফেলিল। বিধান ছুটি লইল একদিনের। সকালে একা গিয়া জিনিসপত্র রাখিয়া আসিতে বেলা তার বারোটা বাজিয়া গেল। শামু আর বিভা দুজনেই তখন স্কুলে গিয়াছে, বাড়িওলার ছেলেরা গিয়াছে আপিস, বনবিহারী গিয়াছে ওষুধ ক্যানভাস করিতে। দুপুরে এখানেই পাতা পাতিয়া তাহারা ভাত খাইল। তারপর বাকি জিনিসপত্র সমেত রওনা হইয়া গেল শহরতলির সেই বাড়ির উদ্দেশে, শ্যামার জীবনের দুটি যুগ যেখানে কাটিয়াছিল। - তেমনি আছে ঘরবাড়ি শ্যামার। শেষবার এ বাড়ি হইতে সে যখন বিদায় লইয়াছিল তখন বাড়িটা শুধু ছিল একটু বিবৰ্ণ, বাড়ির মালিক এখন আগাগোড়া চুনকাম করিয়াছে, রং দিয়াছে। শ্যামা সোজা উঠিয়া গেল উপরে। উপরের ঘরখানাকে আর নুতন বলিয়া চেনা যায় না, বাড়ির বাকি অংশের সঙ্গে মিশ খাইয়া গিয়াছে। নকুড়বাবু দোতলায় ঘর তুলিয়াছে একখানা। রেলের বাঁধটার খানিকটা আড়াল পড়িয়া গিয়াছে। আর কিছুই বদলায় নাই। ধানকলের বিস্তুত অঙ্গগনে তেমনি ধান মেলা আছে, পায়রার ঝাক তেমনি খাইতেছে ধান, উঁচু চোঙাটা দিয়া তেমনি অল্প অল্প ধোঁয়া বাহির হইয়া উড়িয়া যাইতেছে বাতাসে।