পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SS 8 মানিক রচনাসমগ্র ছেলেকে ডাকিযা তুলিতে বড়ো মমতা হয় শ্যামার কিন্তু আজও তো তার কাছে ভবিষ্যতের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, জোর করি যা মণিকে সে তুলিয়া দেয়। বলে, ওঠ বাবা ওঠ, না পড়লে পরীক্ষাব্য যে ভালো নম্বর পাবিনে ? মণি কান্তরকণ্ঠে বলে, আর একটু ঘুমোই মা, কত রাত পর্যন্ত পড়েছি জানো ? জানে না! শ্যামা জানে না। তাব ছেলে কত রাত অবধি পডিয়াছে! দোতলা-একতলাব ব্যবধান কী ফাকি দিতে পারে শ্যামাকে!! --- কতবার উঠিয়া আসিয়া সে উকি দিয়া গিয়াছে মণি তাব কী জানো ! একটু চা বরঞ্চ তোকে করে দি চুপিচুপি, খেয়ে চাঙা হয়ে পড়তে শুরু কর। পডে-শূনে মানুষ হয়ে কত ঘুমোবি তখন—ঘুম কী পালিয়ে যাবে! কনকনে হাঁড-কঁপানো শীত, বকুলকে সঙ্গে কবিয়া শীতল যোবার পালাইয়া গিয়াছিল সেবার ছাড়া শীত শ্যামাকে কোনো বার এমন কাবু করিতে পারে নাই। উনানে আঁচ দিয়া ডালের হাঁড়িটা মাজিতে বসিয়া হাতপা শ্যামার যেন অবশ হইয়া আসে। কী হইয়াছে দেহটাব ? এই ভালো থাকে এই আবার খাবাপ হইয়া যায় ? মাঝে মাঝে এক একদিন তো শীত লাগে না, ঝরঝবে হালকা মনে হয়। শরীরটা, আবছা ভোবে ঘুমন্ত-পুবীতে মনেব আনন্দে কাজে হাত দেয় ? কোনোদিন মনে হয়। বযসটা আজও পাঁচিশেব কোঠায় আছে, কোনোদিন মনে হয় একশো বছরের সে বুডি! এমন অদ্ভুত অবস্থা হইল কেন তাহার ? রোদের সঙ্গে বিধান ওঠে। এখুনি সে ছেলে পডাইতে বাহির হইয়া যাইবে কিন্তু তাহার হইচই হাঁকডাক নাই। নিঃশব্দে মুখহাত ধুইয়া জামা গায়ে দেয়, নীরবে গিযা বান্নাঘবে বসে, শ্যাম। যদি বলে, ডালটা হয়ে এল, নামিয়ে বুটি সেঁকে দি ? ——সে বলে না দেরি হইয়া যাইবে, আগে রুটি চাই। দুটাে একটা কথা সে বলে, বেশির ভাগ সময় চুপ করিয়া ভোববেলাই শ্যামার শ্রান্ত মুখখানার দিকে চাহিত্য থাকে। সে বুঝিতে পারে শ্যামার শরীর ভালো নয়, ভোরে উঠিয়া সংসারের কাজ করিতে শ্যামাপ কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই সে বলে না। মুখের কথায় যার প্রতিকার নাই সে বিষযে কথা বলিতে বিধানের ভালো লাগে না। ভোরে উঠতে বারণ করিলে শ্যামা কি শুনিবে % বিধান চলিয়া গেলে খানিক পরে শ্যামা দোতলায় যায়, এতক্ষণে ছাদে রোদ আসিফাছে । জানালা খুলিয়া দিতে শীতলেব গায়ে রোদ আসিয়া পড়ে। শীতল ক্ষণিকণ্ঠে বলে, কটা বাজল গা ? শ্যামা বলে, আটটা বাজে। --শীতলকে শ্যামা ধরিযা তোলে, জানালার কাছে বালিশ সাজাই যা তাহাকে রোদে ঠেস দিয়া বসায়, লেপ দিয়া ঢাকিয়াও দেয়। গলা পর্যন্ত। শরীরটা শীতলের ভাঙিয়া গিযাছে। দুর্বল পা-টি তাহার ক্ৰমে ক্ৰমে একেবারে অবশ হইযা গিয়াছে, আব্ব সারিবে না। দেহেব অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিও দুর্বল হইয়া আসিতেছে, ক্ৰমে ক্ৰমে তারাও নাকি অবশ হইয়া যাইবে, যাইবেই। কে জানে সে কতদিনে ? শ্যামা ভাবিবারও চেষ্টা করে না। জীবনের অধিকাংশ পথ সেও তো অতিক্ৰম করিয়া আসিয়াছে, ভাবিবার বিষয়বস্তু খানিক-খানিক বাছিয়া লইবার শক্তি তাহাব জন্মিয়াছো-কত অভিজ্ঞতা শ্যামার, কত জ্ঞান! সধবা থাকিবার জন্য এ বয়সে আর নিরর্থক লড়াই করিতে নাই। এ তো নিয়মের মতো অপরিহার্য। আশা যদি থাকিত, শ্যামা কোমর বাধিয়া লাগি৩ শীতলের পিছনে, অবশী পা-টিকে সবল করিয়া তাহাকে খাড়া করিয়া দিত। মিছামিছি। হল্লা শ্যামা আর করিতে চায় না। ক্ষমতাও নাই শ্যামার--অর্থহীন উদবেগ, ব্যর্থ প্ৰয়াসে ব্যয় করিবার মতো জীবনীশক্তি আর কই ? কতকাল পরে সে সুখের মুখ দেখিয়াছে। এবার সংসারের বাঁধা নিয়মে যতখানি আনন্দ ও শান্তি তাহার পাওয়ার কথা সে শুধু তাই খুজিবে, যেদিকে দুঃখ ও পীড়ন চোখ বুজিয়া সেদিকটাকে করিবে অস্বীকার।