পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in S 8 SR মানিক রচনাসমগ্র ভারী ইচ্ছে করছে আমার ভাগনের খোকাকে দেখে আসতে। দেখাবে একবার? কার মতো হয়েছে? তোমার মতো, না তার মার মতো ? কত বড়ো হয়েছে? বললাম, তিন বছর চলছে। চলো না। আমাদের বাড়ি মামি, বাকি প্রশ্নগুলির জবাব নিজের চোখেই দেখে আসবে ? মামি হেসে বললে, গিয়ে যদি আর না নড়ি ? বললাম, তেমন ভাগ্য কি হবে! কিন্তু সত্যি কোথায় চলেছ মামি ? এখন থাক কোথায় ? মামি বললে, থাকি দেশেই। কোথায় যাচ্ছি, একটু পরে বুঝবে। ভালো কথা, সেই বঁশিটা কী হল ভাগনে ? এইখানে আছে। এইখানে ? এই গাড়িতে ? বললাম, কুঁ। আমার ছোটাে বোন বীণাকে আনতে গিয়েছিলাম, সে লিখেছিল। বঁশিটা নিয়ে যেতে। সবাই নাকি শুনতে চেয়েছিল। মামি বললে, তুমি বাজাতে জান নাকি? বার করো না বাঁশিটা?—— ওপর থেকে বাঁশির কেসটিা পাড়লাম। বাঁশিটা বার করতেই মামি ব্যগ্ৰ হাতে টেনে নিয়ে এক দৃষ্টিতে সেটার দিকে চেয়ে রইল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, বিয়ের পর এটাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিলাম, মাঝখানে এর চেয়ে বড়ো শত্র আমার ছিল না, আজ আবার এটাকে বন্ধ মনে হচ্ছে। শেষ তিনটা বছর বঁশিটার জন্য ছটফট করে কাটিয়েছিলেন। আজ মনে হচ্ছে বাঁশি বাজানো ছাড়তে না বললেই হয়তো ভালো হত। বাঁশির ভেতর দিয়ে মরণকে বরণ করলে তবু শান্তিতে যেতে পারতেন। শেষ কটা বছর এত মনঃকষ্ট ভোগ করতে হত না। বঁশির অংশগুলি লাগিয়ে মামি মুখে তুলল। পরীক্ষণে ট্রেনের ঝমােঝমানি ছাপিয়ে চমৎকাব বঁশি বেজে উঠল। পাকা গুণীর হাতের স্পর্শ পেয়ে বঁশি যেন প্ৰাণ পেয়ে অপূর্ব বেদনাময় সুরের জাল বুনে চলল। A. আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ তো অল্প সাধনার কাজ নয়। যার তার হাতে বাঁশি তো এমন অপূর্ব কান্না কঁদে না। মামির চক্ষু ধীরে ধীরে নিমীলিত হয়ে গেল। তার দিকে চেয়ে ভবানীপুরেব একটা অতি ক্ষুদ্র বাড়ির প্রদীপের স্বল্পালোকে বারান্দার দেয়ালে ঠেস দেওয়া এক সুর-সাধকের মূর্তি আমার মনে জেগে উঠল। মাঝে সাতটা বছর কেটে গেছে। যতীন মামার যে অপূর্ব বাঁশির সুর একদিন শুনেছিলাম, সে সুর মনের তলে কোথায় হারিয়ে গেছে। আজ অতসী মামির বঁশি শুনে মনে হতে লাগল। সেই হারিয়েযাওয়া সুরগুলি যেন ফিরে এসে আমার প্রাণে মৃদুগুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। এক সময়ে বাঁশি থেমে গেল। মামির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ঝরে পড়ল। আমারও। কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললাম, এ কথাটাও তো গোপন রেখেছিলে! মামি বললে, বিয়ের পর শিখিয়েছিলেন। বাঁশি শিখবার কী আগ্রহই তখন আমার ছিল। তারপর যেদিন বুঝলাম বাঁশি আমার শত্ৰু সেইদিন থেকে আর ছুইনি। আজ কতকাল পরে বাজালাম। মনে হয়েছিল, বুঝি ভুলে গেছি!! ট্রেন এসে একটা স্টেশনে দাঁড়াল। মামি জানােলা দিয়ে মুখ বার করে আলোর গায়ে লেখা স্টেশনের নামটা পড়ে ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে বললে, পরের স্টেশনে আমি নেমে যাব ভাগনে। পরের সেন্টশনে ! কেন ? মামি বললে, আজ কত তারিখ, জান ?