পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in নেকি পূর্ববঙ্গের মহকুমা শহর । শহর সন্দেহ নেই, তবে বিশুদ্ধ নয়। গ্রামের খাদ আছে। চারিদিক ঘুরে এলে মনে হয়। এ যেন শহর আর গ্রামেব আলিঙ্গনবদ্ধ মূর্তি। বাজার আর আপিস অঞ্চলটুকু দিব্যি শহর। আপটুডেট বাজার,-কলকাতার কোনো নতুন ফ্যান্সি জিনিস উঠলে এক মাসের ভেতরে স্থানীয মনিহারি দোকানগুলিতে আত্মপ্রকাশ করে। একটি মাত্র বঁধানো রাস্তা, মাইলখানেক লম্বা,-বাজারের বুক ভেদ করে, আদালতের গা ঘেঁষে গিয়ে মাটির রাস্তায় আত্মগোপন করেছে। বাজারের কাছে ছোটো ছোটো কয়েকটা শাখাও আছে। বাজারেব কিছু দূরে পাকা রাস্তার ধারে একটি হাইস্কুল। কাছাকাছি পাবলিক লাইব্রেরি, টাউন হল, অফিসারদের ক্লাব, ক্লাব সংলগ্ন টেনিসকোর্ট ইত্যাদি। অভাব নেই কিছুরই। শহর যেমন হয় আর কি ! বাকিটুকু কিন্তু গ্রামছাড়া কিছু নয়। বাড়িঘর সবই প্রায় চাচের বেড়া এবং টিনের ছাদ দেওয়া। কোনো কোনোটার ভিটেটুকু মাত্র পাকা বঁধানো। শুধু তাই নয়, গ্রামের যা প্রধান প্রধান লক্ষণ, প্ৰকাণ্ড প্ৰকাণ্ড আমর্কাঠালের বাগান পুকুর-ডোবা ঝোপ-ঝাড় জঙ্গল বেতবন থেকে আরম্ভ করে সাপ, ব্যাঙ, শিয়াল, বেজি এবং টিকটিকির রাজসংস্করণ গোসাপ পর্যন্ত সমস্তই আছে। শহরের পশ্চিমপ্রান্তে আগাগোড়া চুনকাম-করা একটি পাকা বাড়ি। বাডিটা বরাবব স্থানীয় প্রথম মুনসেফ দখল করে থাকেন। এখন আছেন হেমন্ত মুখার্জি। বাড়িটির পিছনে প্ৰকাণ্ড এক আমবাগান, তারই একদিকে ডোবা সংস্করণ একটি পুকুবা। এ গল্পের আরম্ভ ওইখানে, একদিন বেলা প্ৰায় দশটার সময়। ষোলো-সতেরো বছরের একটি মেয়ে স্নান করছিল। পুকুরের চারিদিকে প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া গাছপালার প্রাচীর। এত ঘন যে আট-দশহাতের ভেতরে এলেও বুঝতে পাবা যায় না। এখানে পুকুর আছে। আশেপাশে বাড়িঘরও বেশি নেই,-—একান্ত নির্জন। মেয়েটির শঙ্কা ছিল না, নিত্যকার মতো সমস্ত পুকুরটা সাঁতরে এসে নিশ্চিন্তচিত্তে অঙ্গমার্জনা করছিল। হঠাৎ ওপারে নজর পড়তে দেখল, বছর বাইশ তেইশের একটি ছেলে, চোখে সোনার চশমা, একটা আমগাছের গুড়ি ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। ত্ৰস্তভাবে নিজেকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে দিযে মেয়েটি সংযত হয়ে নিল। জড়োসড়ো হয়ে তেমনিভাবে গলা পর্যন্ত জলে ডুবে দাঁড়িসো রইল। ভাবল, ভদ্রলোকের ছেলে, সরে যাবে। ছেলেটির কিন্তু নড়বার লক্ষণ দেখা গেল না। তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। রাগে বিরক্তিতে মেয়েটি ঠোঁট কামড়ে ধরল। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জল থেকে উঠে এল। তাবপর ধীরোপদে ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেল। ছেলেটি নিবিষ্টচিত্তে গাছের উপর কী দেখছিল, যেন পৃথিবীর আর কোনো দিকে তার লক্ষ নেই! রাগে গা জ্বলে গেল। তিক্তস্বরে মেয়েটি বললে, দেখুন— ছেলেটি চমকে তার দিকে তাকাল।