পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SVO মানিক রচনাসমগ্র অশোকের বাবার ছুটি নেই, রাঁচি পর্যন্ত যেতে পারবেন না। কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে তিনি ফিরে যাবেন, কলকাতা থেকে অশোককে সঙ্গে যেতে হবে। সে যেন প্রস্তুত হয়ে থাকে। চিঠি পড়ে অশোক মিনিট পনেরো ভাবল, তারপর সুটকেস গোছাতে বসল। সেইদিন রাত্রের সিরাজগঞ্জ মেলে উঠে বসল। মা বললেন, তোর আসবার দরকার ছিল না। আমরাই তো কলকাতা যাচ্ছিলাম। যাক, বেশ করেছিস । অশোক মুখ নত করলে। কেন যে এল, সে প্রশ্নের বিরামহীন মহলা তো তার মনেই চলেছে! জবাব দেবে কী? তোর কি কোনো অসুখ হযেছিল। অশোক ? অশোক ঘাড় নেড়েই প্রশ্ন করল, পুলকের স্কুল তো ছুটি হয়নি? ও কি এখানে থাকবে ? কথা ঘুরিয়ে নেবার জন্য ছেলের প্রয়াস দেখে ম্যাব চোখে জল এল। বললেন, থাকবে? থাকবার ছেলেই বটে। আর জানিস, নেকি আমাদের সঙ্গে যাবে। অশোক চমকে উঠল। মেয়েটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে রে! তুই থাকতেই ম্যালেরিয়া ধরেছিল, এখন কালাজ্বরে দাঁড়িয়েছে। অত্যাচারের তো সীমা ছিল না। জ্বর গায়ে কবার যে স্নান করত। ঠিক নেই। কী চেহারা হয়ে গেছে! মা একটা নিশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। মার চেঞ্জে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য এবার আর অশোকোব কাছে গোপন রইল না। নেকি অল্প অল্প হাঁটতে পারত, কিন্তু আমবাগান পার হয়ে আসবার আর ক্ষমতা ছিল না। মা পালকি নিয়ে গিয়ে নিজে তাকে নিয়ে এলেন। অশোক উঠানে দাঁড়িয়েছিল, পালকির খোলা দরজা দিয়ে তার দিকে চেয়ে নেকি স্নান হাসি হাসল। রাগ নেই, দ্বেষ নেই, অভিমান নেই, সারারাত্রি ঝডের মুখ ফিরিয়ে নিল। নেকির পিসির অসুখ, চক্ৰবতীর তাই এই সঙ্গে যাওয়া হল না। পিসি একটু ভালো হলেই যাবেন। যাত্রা করবার সময় ভদ্রলোক হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন, অশোকের মাকে উদ্দেশ করে বিকৃত কণ্ঠে বললেন, আমার আর কেউ নেই মা, ওকে আপনি ফিরিয়ে আনবেন। চক্ৰবতীর ওপর অশোকের বিতৃষ্ণর সীমা ছিল না, আজ তার মনে হল এর চেয়ে ভালো লোক বোধ হয়। পৃথিবীতে নেই! শহরের প্রান্তবাহী ছোটাে নদীটি বর্ষার জলে ভরে উঠেছে। স্টিমারঘাট পর্যন্ত গাড়ি যায় না, নীেকোয় যেতে হয়। স্টিীমারঘাট শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। স্টিমারে উঠে নেকি কেবিনে ঢুকতে রাজি হল না। রেলিঙের পাশে ডেকচিয়ার পেতে তাকে বসিয়ে দেওয়া হল। অশোক আর তার মা কাছেই বসলেন। নেকি একদৃষ্টি মেঘনার জলরাশির দিকে চেয়ে রইল। স্টিমার এক তীর ঘেঁষে চলেছে, ওপারের তটরেখা অস্পষ্ট। দু বছর আগে এই পথ দিয়েই সে একটা অতিপরিচিত জীবনকে পিছনে ফেলে দুরুদুরু বুকে অজানা অচেনা জীবনের মাঝে গিয়ে পড়েছিল। আজ আবার সেই পথেই কোনাে নতুন জীবনের সন্ধানে সে চলেছে কে জানে! দেনাপাওনা হয়তো মিটবে না, ওপারের তটরেখার মতোই অস্পষ্ট অনুভূতি তাকে চিরন্তন জীবনের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে সে জীবনে যেতে মন হয়তো তার কেঁদেই উঠবে। কিন্তু যেতে বোধ হয় হবেই।