পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SVV) মানিক রচনাসমগ্ৰ রাত্রিদিন ভাবতাম। স্বামী আমার কাছে ছোটাে নয়।--তুচ্ছ নয়- কিন্তু পর। সব স্বামীই পর-নিজের চেয়ে মানুষের আপনাব কেউ নয়—প্রেমে নয়, স্নেহে নয়। প্রেম দুটি আত্মাকে কাছে আনে কিন্তু আত্মগত আত্মার চেযে কাছে-আসা আত্মার দূরত্ব বেশি। তাই আমি ভাবতাম যে, শুধু পরের কল্যাণেই বেঁচে থাকিব, আমার আত্মার কল্যাণ নেই? আমার জীবন তাদেরই কল্যাণে বার্থ হবে যাদের কল্যাণ হয় না? সবাই পবের জন্যেই অবশ্য বেঁচে তাকে, কিন্তু নিজের জন্য আহরণ করে ওই বেঁচে থাকবে সার্থকতটুকু। ওবই নাম নিজের আত্মাব কল্যাণ। নিজেকে দিলাম। কিন্তু দেওয়াটা মিথ্যা হল না, এইটুকু। অন্যায়েব বিনাশের জন্য দধীচির আত্মদান-ইন্দ্ৰ বজ্ৰ নিয়ে খেলা করবে বলে নয়। আমি দধীচিব মেয়ে নই। যদি হইও দধীচির মেয়ে, আমার অস্থির বীজ নিভে গেছে। একটু তাপ শুধু আছে নেভা বজের ভস্মে। সেইটুকু যদি বরফের ঘর গরম রাখতে ব্যয করে যেতাম, মরবার সময অপচয়ের স্মৃতিতে আমার আত্মা দগ্ধ হত। আজীবন স্বামী-সেবার পুণ্যও পুড়ে হত ভস্ম! কারণ, সাবা জীবন চোখ বুজে কাটিয়ে মরবার সময় আমি চোখ মেলে দেখতাম দুর্লভ জীবন কার পূজায় কাটল। তখন জীবনব্যাপী দানবী-পূজার আপশোশ নিযে আমায় পরলোকে যেতে হত। আপশোশ নিযে মানুষ কোন পরলোকে যায় জান ? নরকে । আমি বললাম, এটুকু বুঝলাম। কিন্তু আসল কথা এখনও বলিনি। তোমার তো শুধু স্বামী নয়, দুটি ছেলে। সে সংশোধন কবে বললে, দুটি না, ছটি। চারটি স্বৰ্গে গেছে। দুটি গর্ভেব অন্ধকার থেকে, দুটি পৃথিবীর আলো দেখে। না, দুটিই আলো দেখে নয়, একটি অন্ধ হয়ে জন্মেছিল। এ বারতায় ব্যথা ছিল, আঘাত ছিল, আমাদের শিশু জগতে স্থায়ী মডক আছে সে কথা শুনেছিলাম। শুনেছিলাম মানে দৈনিক অথবা মাসিকে পডেছিলাম। শুধু পড়েছিলাম। কখনও ভেবে দেখিনি শিশুর মবণেব শেষ শিশুর মরণে নয, মমতাদির মতো অসংখ্য মাতার মর্ম বেদনায়। জগতে যার বাড়া মৰ্ম-বেদনা নেই। সে বললে, তুমি ভাবছ। এতক্ষণ ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ তুলে রেখেছিলে, ছেলে দুটিব। কথা তুলে আমাকে কাবু করবে। ছেলেই বটে! বড়ো ছেলের বয়স বারো—মনের বিকৃতিতে বারো শো। সে চোর, তডিখোর, কুটিল, রাগি, বোকা, অলস। ছোটেগটিও অমনিভাবে গড়ে উঠছে—দুজনেই একদিন বাপেৰ মতো হবে। তাত খারাপ দু বলে আমি জিভা কাটলাম । সে বললে, জিভ কেটো না। সারা জীবন কথা কইতে হবে—এখন জিভ কাটা গেলে মুশকিল। নিজেই স্বামীনিন্দে জুডেছি, তোমাব কথায় আর কত ব্যথা পাব ? আমার ছেলে দুটি বাপের মতো অত খারাপ যদি নাও হয়, যেটুকু হবে তাতেই প্ৰকাণ্ড অমানুষ হবে। সদগুণে বোঝাই হযে করবে: ত্ৰিশ টাকার কেবানিগিরি—তাতেই অধিকাৰী হবে স্ত্রী-পুত্র সংসারের। দশ বছরে দশটা কুকুর-ছনার বাপ হবে-অকালমৃত্যু এড়াতে পারলে যারা বড়ো হয়ে দশ দিশে একশোটা শূকর-ছানা পৃথিবীকে উপহার দেবে। অবিশ্বাস করছ? পৃথিবী এমনি করে ভারাকান্ত হ্রয় ভাই-একটা গলিত আত্মায় হাজার হাজার গলিত আত্মাৰ বীজ কিলবিল করে। এই জন্যে যিশু বলেছিলেন, একটি পাপী স্বগের দিকে মুখ ফেরালে স্বৰ্গরাজ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। একটি মানুষ থেকে মানবজাতি হয়েছে।--কে বলতে পারে একটি পাপী থেকে একদিন একটা বিরাট পাপীর জাতি পৃথিবীতে দেখা দেবে না ? একটি অমানুষের মধ্যে সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের সম্ভাবনা নিহিত আছে। অমনি অমানুষ হয়ে উঠছে আমার ছেলেরা! দশ মাস দেহের মধ্যে বয়ে বেড়িয়েছি, নিজের রক্তে পুষ্ট করেছি, দিনের পর দিন বুকে নিয়ে পালন করেছি, স্নেহ করেছি, ভালোবেসেছি, জগতের দুটি অভিশাপকে। জ্ঞানের আলোয় নিজের এই মহৎ দুষ্কর্ম চিনে আমি পালিয়ে এসেছি। পাপে আমার বিরাগ, ব্যর্থতায়