পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SRO মানিক রচনাসমগ্র খোঁচাচ্ছি ? মাইরি না। কালীর দিব্যি। স্বামীর ভাষাতে প্রতিবাদ করলাম, আর রাগ কোরো না। বলে সে হাসল। আমি গভীর হয়ে ভাবতে লাগলাম। সেও গভীর হয়ে বললে, সত্যি খোচাইনি ভাই। খোঁচাবার অধিকার কোথা পাব ? যার যে অধিকার নেই সে তা করলে ভেবে নিতে হয়। ঠাট্টা করেছে। খোচাবার অধিকার তোমার কাছে। না, নেই! আমার দেশসেবা যে বাধ্যতামূলক। সে সবারই। অধীনতা বাধা করে। করে কি? অধীনতার দুঃখ না। স্বাধীনতার লোভ করে কী করে জানলে ? না ভাই জবাব চাইনি। এ কথার জবাব মানে আধঘণ্টা ধরে তোমার বক্তৃতা। আমি জানি জবাব। দুই কারণেই। কিন্তু ও রকম দেশসেবা বাধ্যতামূলক নয়। ভাই। তা হলে মাতৃস্নেহকেও বাধ্যতামূলক বলতে হয়। আমার এই সেবা কিন্তু সত্যি বাধ্যতামূলক। সে জীবন সইল না বলে আমি এ জীবনে আশ্রয় নিয়েছি।--ঝড়ে ভাঙা তরী এনেছি বন্দরে। বেশি নয়, একটা ছেলেকেও যদি মানুষ করতে পারতাম আমি সেখানকার মাটি কামড়ে থাকতাম। আকণ্ঠ নয়, ব্যর্থতায় একেবারে তলিয়ে গিয়ে দম আটকাল বলেই না। এখানে নিশ্বাস ফেলতে এসেছি! আমি আজ সুখী দুঃখী দুই, কিন্তু এগারো বছর যে দেয়ালের অন্তরালে ছিলাম সেখানে থেকে সন্তানের মধ্য দিয়ে দেশের সেবা করতে পারলে আরও সুখী হতাম। কিন্তু এ কথাটাও বলি, আমার এ জীবন তুলনাহীন। ছিলাম যন্ত্ৰ-আজ আমি মানবী, যার আত্মা আছে, যার জীবনের অনেক মূল্য, অনেক প্রয়োজন, অনেক মানে। বেশি কী, আমি আজ তোমার প্রণম্য! আমি নীরবে তাকে প্ৰণাম করলাম, পেলাম আশীর্বাদ। তারপর চুপ করে বসে রইলাম। সূর্য তখন নদীর অপর তীরে, তরুশ্রেণির খানিক উর্ধে। নদী দিয়ে একটি স্টিমার চলে গেল, তীরে আছড়ানো ঢেউ-এর শব্দ মৃদুভাবে কানে এল। কয়েকটা বক নদীতীরে বসে ছিল, হঠাৎ উড়ে গেল। মমতাদি বোধ হয ভাবেনি এত শিগগির আমি তাকে রেহাই দেব। স্পষ্ট অনুভব করলাম সে আমার কথা বলার প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু আমি আর মুখ খুললাম না। কত কথা তো বললাম, কিন্তু কথা বলে লাভ কী? সংসারের জ্বালায় কত মানুষ গেরুয়া পরে পালিয়েছে, কত মানুষ খেপে গেছে, কত মানুষ আত্মহত্যা করেছে। —মমতাদি যদি জগতের মধ্যে মহত্তম কর্ম-বৈরাগ্যে আধাপোড়া মনের আগুন নেবাতে চায়, কথার বিনিময়ে কোনো কিছুর এদিক-ওদিক হবে না। পরিণয়ের যজ্ঞভস্মে ঘি ঢেলে চলা যত বড়ো কর্তব্য হোক, সেটা ঘিয়ের অপচয় নিশ্চয়ই ; সে অপচয় বন্ধ করা যত বড়ো অকৰ্তব্য হােক, স্বাধীনতার হােমানলে ঘি ঢেলে চলা যে ঘিয়ের সবচেয়ে সদব্যবহার তাও নিশ্চয়ই। সুতরাং নানাবিধ ধারণা ও সংস্কারে বোঝাই মন নিয়ে তর্ক করা কথারই অপচয়। অতএব কথা বন্ধ করে আমি ভাবতে লাগলাম অধুনা-পরিত্যক্ত স্বামী-পুত্রের কল্যাণে এই নারীটি একদিন আমাদের বাড়ি রাঁধুনি হয়েছিল,-গভীর রাত্রে ঘুমের কবল থেকে ছিনিয়ে-নেওয়া কয়েক ঘণ্টা সময় ছাড়া এগারোটি বছর একটানা বেঁচেছিল শুধু স্বামী-পুত্রের জন্য। স্নেহ, প্রেম, মমতা মানুষের নাগপাশ । নাগপাশে মূৰ্ছার তন্দ্ৰা। সে নাগপাশে আবদ্ধ থেকেও যে মোহনিদ্রা টুটিয়ে দিলে, বঁধন-সুদ্ধ যে বেরিয়ে পড়ল পথে, পাশবদ্ধ কর্মশক্তি নিয়ে যে সকলের জন্য যে-বিপুল কাজ পড়ে আছে তার নিজের ভাগটুকু শেষ করতে প্রবৃত্ত হল তাকে বোঝা যায় না। সে দুর্বোিধ, তাকে ঘিরে রহস্য। মমতাদির শান্ত ও গভীর মুখ দেখে আমার মনে হল, রাঁধুনির কাজ নিতে এসে যে আমার শেষ-শৈশবে স্নেহ-করার শক্তিতে রহস্যময়ী হয়ে উঠেছিল, আজ আমার প্রথম যৌবনে সে আবার স্নেহ অস্বীকার করার শক্তিতে রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে।