পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SV মানিক রচনাসমগ্ৰ সান্নিধ্যে সে ওদের কাছে হয়ে ওঠে। হরিণীর মতো চপল,--রানির মতো প্রভাবশালিনী, অভিনেত্রীর মতো। রহস্যময়ী, প্ৰবঞ্চিতার মতো সংযত, প্রজাপতির মতো হালকা। তার পাশে অনিন্দিতা বৈদ্যুতিক বালবের পাশে প্রদীপের মতো নিভে যায়। শিপ্রার দিকে তাকিযে পরাশর চিন্তিত হয়ে ওঠে। নাম ছড়ায়। কলকাতার একটি নগণ্যা স্কুল-মিস্ট্রেস আশেপাশের দশটা গ্রামে আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। একদিন সন্ধ্যার পর বেড়িযে ফিরবার সময় অন্ধকারে একটা মাটির ঢেলা শিপ্রার পিঠে এসে গুড়ো হয়ে যায়, আট-দশ মাইল দূরের গ্রাম থেকে দু-একজন তাকে দেখতে আসে। জীবনের ত্ৰিশটা বছর মানুষের মতামতকে সম্মান করে নিরীহ ও ভীরু হয়ে থেকে একটি কাম্য ভবিষ্যৎকে হঠাৎ একদিন গায়েল জোরে সৃষ্টি করার চেষ্টা শুরু করেই শিপ্রা চারিদিকে বিস্ময় কৌতুহল ও কৌতুক পুঞ্জীভূত করে দেয়। যৌবনের মৃত্যুর তার বেশি দেরি নেই। সমস্ত ভয়ভাবনা বিসর্জন দিয়ে জীবনকে সে মরণকামড় দিয়ে আয়ত্ত করতে চায়। অনিন্দিতার বাবা ছিলেন বিদেশে। অনিন্দিতার মা সভয়ে মেয়েকে বলেন, এ তুই কাকে বাডি নিয়ে এলে আনি ? অনিন্দিতা চিন্তিত মুখে বলে, ওর বোধ হয় নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে মা । নাৰ্ভাস ব্রেকডাউন হোক আর যাই হােক। ওকে এবার তুমি যেতে বলো বাছা। দশ-বাবে দিন হয়ে গেল, এখনও কোন লজায় ও পরের বাড়ি পড়ে আছে? দেখি আর দুটাে দিন। কিন্তু শিপ্রা যাই আরম্ভ করুক, একটা আশ্চর্য সংযম সে আগাগোডা বজায় বেখে চলছিল। তার সাজগোজ অশ্লীল নয, তার আড়াতে হাল্লা হয় না, তার ফ্লার্টিং শুধু কথা ও হাসির। ভোরে ঘুম ভেঙে রাত্রে বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত অজস্র খাপছাড়া কাণ্ডে সে সকলকে উত্তেজিত কবে বাখে কিন্তু নিজে সে উত্তেজিত হয় না। তার কথা হয় মৃদু ও সুরের রেশ লাগানো, তার হাসি হয় অপার্থিব একটা অধর-ভঙ্গি, তার চলন হয় টিমে তালের একটা নৃত্যছন্দ ! এক কাবাত্মক আভিজাত্য, খুব উচুস্তরের আধুনিকতা ব্ৰহ্মান্ত্রের মতো আত্মরক্ষার জন্য সে পরিস্ফুট করে রাখে। গ্রামের অল্পশিক্ষিত অল্প আলোকপ্ৰাপ্ত নবনাবীর মধ্যে সে আলোর মতো উদয় হয়েছে, এরা মাদি তাকে পছন্দ না কবে। সেটা হবে এদেরই সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারের দোষ, এদেরই পিছনে পড়ে থাকার পরিচয। এ ছাড়াও শিপ্রোর আরও একটা চালাকি আছে। অনেক ভেবে কৌশলে সে এই ভাবাটাও বজায় রেখেছে যে, সে সকলকে মাতায়নি তাকে নিয়ে সকলে মেতেছে। অনিয়ম ও অসংযম যদি কিছু ঘটে থাকে তার দায়িত্ব অন্যের, তার নয়। পরাশর প্রথমে দূর থেকে শিপ্রাকে লক্ষ করছিল, অনিন্দিতার মধ্যস্থতায় তার সঙ্গে প্রথম যে ভদ্রতার পরিচয় হযেছিল। মাঝখানে অনিন্দিতাকে খাড়া রেখে এ পরিচয়কে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে দেয়নি। কিন্তু অনিন্দিতাকে শিপ্রা এক রকম ঠেলে সবিয়ে দিল। অনিন্দিতার ক্ষমতা রইল না পরাশরের সান্নিধ্যে শিপ্রাকে সহ্য করে। শিপ্রার এক একটি বানানো কথা, এক একটি নকল হাসি তার কানে আর চোখে বিধতে আরম্ভ করতেই সে দুজনকে আসর ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। তখন শিপ্রার বন্ধ হয়ে উঠতে শহরবিরহী পরাশরের সূর্যকে বার তিনেকের বেশি অস্ত যেতে হবে না। পরাশরকে শিপ্রা যখন সকালে প্যারাসোল হাতে বেড়াতে যাবার সময়, অপরান্তে বসে গল্প করার সময়, সন্ধ্যায় নদীর ধারে নির্জনতা উপভোগ করাব সময় এবং রাত্রে গান শোনাবার সময় কাছে রাখার শক্তি অর্জন করলে, কলেজের ছেলেগুলিকে সে তখন বিদায় করে দিলে। চিরবিদায় নেওয়া সে সব ছেলেমানুষগুলির পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাদের চিরবিদায় দেওয়া শিপ্রাও ভালো মনে