পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Sybr মানিক রচনাসমগ্ৰ কালো হইয়া যাইত। পাগলামি ছিল তাহার এইখানে। সে জানিত বোকা পাইয়া সকলে তাহার ঘাড় ভাঙে, তবু ঘাড় ভাঙিতে না দিয়াও সে পারিত না। শেষে, শ্যামাব বিবাহের প্রায় চার বছর পরে শীতলের প্রেস বিক্ৰয় হইয়া গেল। আবোলতাবোল। যেমনি খবচ কবুক আয় ভালো থাকায় এতকাল মোটামুটি একরকম চলিয়া যাইত, প্রেস বিক্ৰয় হইয়া যাওয়ার পব তাহাদেব কষ্টের সীমা ছিল না। বাড়িটা পৈতৃক না হইলে মাঝখানে কিছুদিনের জন্য হয়তো তাহদের গাছতলাই সারা করিতে হইত। এই অভাবের সময় শ্যামার মামার সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হওযাব শোক শীতলের উথলিয়া উঠিয়াছিল, সব সময় শ্যামাকে কথার খোচা দিয়াই তাহাব সাধ মিটিত না। শ্যামাব গায়ে তাহার প্রমাণ আছে। প্রথম মা হওযার সময় শ্যামার কোমরের কাছে যে মস্ত ক্ষতের দাগটা দেখিযা বুড়ি দাই আপশোশ করিয়াছিল এবং শ্যামা বলিয়াছিল ওটা ফোঁড়াব দাগ, ছড়ির ডগাতেও সেটা সৃষ্টি হয় নাই, ছাতির ডগাতেও নয়। ওটা বঁটিতে কাটার দাগ। বঁটি দিয়া শীতল অবশ্য তাহাকে খোচায় নাই, পা দিযা পিঠে একটা ঠেলা মারিয়াছিল। দুঃখের বিষয়, শ্যামা তখন কুটিতেছিল তবকারি। তবকারি সে আজও কোটে। সুখে দুঃখে জীবনটা আমনই হইয়া গিয়াছে, সিদ্ধ কবিবাব চাল ও কুটিবাব তবকাবি থাকার মতো চলনসই। অনেকদিন প্রেসেব মালিক হইয়া থাকার গুণে একটা প্রেসের ম্যানেজাবির চাকবি শীতল মাস ছয়েক চেষ্টা করিয়াই পাইয়াছিল। শ্যামা প্ৰথমবােব মা হওয়াব সময় শীতল এই চাকবিই করিতেছিল। বিবাহের সাত বছব পাবে প্রথম ছেলে হওযাটা খুব বেশি বিস্ময়েব ব্যাপাব নয়। অমন বিলম্বিত উর্ববতা বহু নাবীব জীবনেই আসিয়া থাকে। শ্যামার যেন সব বিষযেই বােডাবাড়ি। প্রথম ছেলেকে প্রসব কবিতে সে সময় লইল দুদিনের বেশি এবং এই দুটি দিন ভবিয়া বাববার। মূৰ্ছা গেল। শেষ মূৰ্ছা ভাঙিবার পর শ্যামা এক মহামুক্তির স্বাদ পাইযাছিল। দেহে যেন তাহার উত্তাপ নাই, স্পন্দন নাই, সবগুলি ইন্দ্ৰিয় অবশ বিকল হইয়া গিয়াছে সে বাতাসের মতো হালকা। শীতকালের পুঞ্জীভূত কুযাশাব্য মতো সে যেন আলগোছে পৃথিবীতে সংলগ্ন হইয়া আছে। তাহার সমগ্ৰ বিস্ময়কর অস্তিত্ব ব্যাপিয়া এক তরঙগাযিত স্তিমিত বেদনা, মৃদু অথচ অসহ্য, দুৰ্ত্তেয় অথচ চেতনাময়। একবাব তাহার মনে হইল সে বুঝি মবিয়া গিয়াছে, ব্যথা দিযা ফাপানো এই শূন্যময অবস্থাটি তাহাব মৃত্যুবই পরবর্তী জীবন। ভেঁাতা। যাতনা তাহাব অশরীবী আত্মার দুর্ভোগ। তারপর চোখ মেলিয়া প্রথমটা সে কিছুই বুঝিতে পারে না। চোখের সামনে সাদা দেযালে একটি শায়িত মানুষের ছায়া পড়িয়াছে। ছায়ার হাতখানেক উপরে জানালাব একটা পাট অল্প একটু ফাক কবা। ফাঁক দিয়া খানিকটা কালো আকাশ ও কতগুলি তারা দেখা যাইতেছ। একটা গরম ধোয়াটে গন্ধ শ্যামার নাকে লাগিয়াছিল। কাছেই কাদের কথা বলিবার মৃদু শব্দ। খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিবার পর দেয়ালের ছায়াটা তাহাব নিজের বলিয়া চিনিতে পারিয়া সে একটু আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিল। এমনভাবে সে শূইয়া আছে কেন? তাহাব কী হইয়াছে? কাঠকয়লা পুড়িবার গন্ধ কীসের ? কথা বলিতেছে কাবা ? হঠাৎ সব কথাই শ্যামার মনে পড়িযা গিয়াছিল। পাশ ফিরিতে গিয়া সর্বাঙ্গে বিদ্যুতের মতো তীব্র একটা ব্যথা সঞ্চারিত হইয়া যাওয়ায, সে আবার দেহ শিথিল করিয়া দিয়াছিল। মনের প্রশ্নকে বিকুলের মতো উচ্চারণ করিয়াছিল। এই অর্থহীন ভাষায় : কোথায় গেল, কই ? কে যেন জবাব দিয়াছিল : এই যে বউ এই যে, মুখ ফিরিয়ে তাকা হতভাগি! কাছে বসিয়াও অনেকদূর হইতে যে কথা বলিয়াছিল সেই বোধ হয় শ্যামার একখানা হাত তুলিয়া একটি কোমল স্পন্দনের উপর রাখিয়াছিল। জাগিয়া থাকিবার শক্তিটুকু শ্যামার তখন ঝিমাইয়া আসিয়াছে। সে অতিকষ্টে একটু পাশ ফিরিয়াছিল।