পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি >br> বরফের মতো। ঠান্ডা। আর শক্ত। তাই বা মন্দ কী? বরফ দিয়ে আইসক্রিম হয়, পাথর চিরকাল পাথর। এমনিভাবে হেঁয়ালিতে কথা বলার জন্য তাদের মন খারাপ হয়ে যায়। শিপ্রাকে সঙ্গে নেবাব কথা ভুলে গিযে পরাশর একা চলে যায় পুকুরে, পুকুরের মাঝখানে সাঁতার দেবার চেষ্টা না করে চোখ বুজে চিত হয়ে ভাসে। অনিন্দিতা শিপ্রাকে পরাশরের গন্তব্য স্থানের সন্ধান বলে দিয়ে আবেলায় বাড়ির পাশের পোড়ো জমিটাতে ইজেল খাড়া করে ছবি আঁকতে আরম্ভ করে। একটি একটি করে দিন চলে যায় কোকিনদের আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদটি কলায় কলায় বাড়তে থাকে। পূর্ণিমার আগের রাত্রে পরাশর ও শিপ্রার বিবাহের সময় স্থির হয়েছে বলে চাঁদের নৈশ বুদ্ধিতে অনিন্দিতা মৃদু কৌতুহল বোধ করে। শিপ্রা তার হাজারিবাগের পিসিমাকে পত্র লিখেছিল। পত্রে সে প্রস্তাব করেছিল যে পিসিমা যদি কলকাতায় এসে তার বিয়েটা দিয়ে দেন তবে বড়ো ভালো হয়। পিসিমা চিঠির জবাবে লিখেছেন, তঁাব বড়ো টাকার টানাটানি, কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে শিপ্রার বিয়ের আয়োজন করার সংগতি তীব নেই। শিপ্রা টাকা পাঠালে ব্যবস্থা করতে পারেন। শিপ্রা নিঃসংকোচে এ চিঠি পরাশরকে দেখিয়েছে। পবাশার বলেছে, তাই তো ! তখন শিপ্রা বুদ্ধি খাটিয়ে এক উপায় উদভাবন করেছে। কোকিনদে বিয়ে হতে কোনো অসুবিধা নেই, তার উদভাবিত উপায়ের মর্মকথাটি এই। এবং কোকিনদেই। যদি বিয়ে হয়, অনিন্দিতার বাড়িতে না হলে তাকে বিশেষ অপমান করা হবে। এ বিয়ে যে হচ্ছে অনিন্দিতাই কি তার কারণ নয়? তাছাড়া সে তাদের দুজনেবই বিশিষ্ট বান্ধবী। প্রস্তাবটা যে অনিন্দিতার দিক থেকেই ওঠা উচিত ছিল এটা খেয়াল করে তারা দুজনেই অস্বস্তি বোধ করে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলে না। পরাশরের বাবা ও মা শেষ পর্যন্ত মত দিলেও এ বিয়ে তঁরা অনুমোদন করেননি, গম্ভীর উদাসীন হয়ে আছেন। পাত্রপক্ষের বিয়ের আযোজনও অনিচ্ছক মন্থর গতিতে চলেছে। পাত্রীর এক পিসিমা পুথিবীর কোথাও আছে এবং পাত্রীপক্ষে যতটুকু আয়োজন দরকার তিনিই তা করবেন। এমনি একটা আভাস পেয়ে পরাশরের আত্মীয়স্বজন চুপ করে আছে। এখন এ পক্ষের ব্যবস্থার ভারটাও তাদের নিতে বলার সাহস পরাশরের নেই। শিপ্রো ইচ্ছা করলে এই অসুবিধা রদ করতে পারত। দুটি সুব্যবস্থা সম্ভব ছিল। হাজারিবাগের পিসিমাকে মধু বোসের আর্থিক অবস্থার বিবরণ লিখে জানিয়ে অভয় দিলে তিনি কলকাতায় ছুটে এসে উৎসবের আয়োজন করতেন। কলকাতায় শিপ্রার কয়েকটি বন্ধু আছে। তাদের অনুরূপ বিবরণ দিয়ে পত্র লিখলে তারা দরকার হলে চাঁদ করেও শিপ্রার বিয়েতে দু-চারশো টাকা খরচ করতে পিছপা হত না। কিন্তু শিপ্রা অনেক ভেবে এদিক দিয়ে কোনো চেষ্টাই করেনি। পরাশরেব কাছে নিজেকে সে অসহায় অনন্যনির্ভর করে রাখতে চায়। পরাশর শুধু ভালোবেসেই তাকে গ্ৰহণ করছে। না, তাকে দয়া করছে। সহায়-সম্পদহীনা এক নারীর প্রতি এ তার অনন্ত অনুগ্রহ। শিপ্রা জানে এই করুণার ভেজাল-মেশানো প্রেম খাদ-মেশানো সোনার মতো খাঁটি জিনিসটির চেয়ে শক্ত হয়। চারিদিক থেকে বাধা ও আঘাত পেয়ে শেষের দিকে পরাশীর যদি ভালোবাসাকে অস্বীকারও করতে চায়, এই ভেজালকে তার মানতে হবে। জগতে যার কেউ নেই তাকে সে কোনো কারণেই ভাসিয়ে দিতে পারে না । শুক্লা নবমীর সকালে অনিন্দিতার কাছে সেই কথা পাড়ল। বললে, নিজের ভার আর বইতে পারি না অনি।