পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি Sb6 তিন বছর পরে তুমি এলেঅনন্তের চমক লক্ষ করিয়া কেতকী হাসিয়া কথাটা শেষ করিল,--আর বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি মন্দির ! অনন্তও হাসিল। বলিল, অভ্যর্থনা করার জন্য তুমি দেউড়িতে দাঁড়িয়ে নেই দেখে রাগ হয়েছিল। কেতকী বলিল, দাঁড়িয়ে থাকতাম, কিন্তু তুমি এত আগে এসে পড়বে ভাবিনি। এখানে পৌঁছতে প্ৰায় সন্ধ্যা হয়ে যায় । ভালো ভালো খাবার ঘুষ পেয়ে বেহারারা উড়ে এসেছে। অত খাবার পাঠিয়েছিলে কেন বলো তো ? বলিয়া অনন্ত হাসিতে লাগিল। কেতকী বলিল, বিলিয়ে দিয়েছ বেশ করেছ, নিজে পেট ভরে খেয়ে নিয়েছিলে তো ? নিয়েছিলাম। আর খেতে খেতে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলাম। এই ভেবে যে, আমি কী খেতে ভালোবাসতাম। সব তোমার মনে রইল কী করে! লেবুর শরবতটি পর্যন্ত তো ভোলনি ? কেতকীর মুখের পাশে রোদ পড়িয়াছিল, একটু ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া মৃদু হাসিয়া সে বলিল, যেন কত জন্ম কেটে গেছে, ভোলাই উচিত! তিন বছরেই মানুষের স্মৃতি লোপ হয় এই বুঝি তোমার ধারণা ? কী করে চিনলাম ভেবে তো কই আশ্চর্য হলে না ? অবিকল এমনিভাবে কেতকী হাসিত, এমনি ভঙ্গিতে কথা কহিত, প্রত্যেকটি বাক্য তাহার এমন রসাত্মক লাগিত যেন এক একটি সংক্ষিপ্ত স্বতন্ত্র কাব্য। অথচ পরিবর্তন হইয়াছে। এত বেশি হইয়াছে যে তাহা লইয়াই আর একটু হইলে সে প্রথম কথা আরম্ভ করিয়া দিত। ভারী ছেলেমানুষি শোনাইত তাহা হইলে। মনে হইত এ একটু নুতনভাবে ভদ্রতার কুশল প্রশ্নটিই সে করিয়াছে। তিন বছর পরে দেখা হওয়ার প্রথম দিকে অসংখ্য ছোটোখাটো প্রশ্নোত্তবের মধ্যে পরিবর্তনের বিবরণ দাখিল করিতে কেতকীরই কি ভালো লাগিত? কুশল জিজ্ঞাসা কবিতে আশঙ্কাও হয। গায়ের রং মলিন হইয়া দেহের গড়ন ভাঙিয়া গিয়া কী চেহারাই আজ ইহার হইয়াছে? মুখে লাবণ্যের লেশ নাই, চোখ দুটি স্তিমিত। অসময়ে গা ধুইতে গিয়া স্নান কবিয়া আসিয়াছে, তবু! এখন যে তুমি স্নান করেছ কেতকী? পুজো করবে না কি মন্দিরে ? আমি ওই মন্দিরে পুজো করব? কেতকী যেন আশ্চর্য হইয়া গেল। মন্দিরে পুজো হয় না ? হয । ও করে। এবার অনন্তের আশ্চর্য হইবার পালা। শঙ্কর দেবমন্দিরে পূজা করে। সেই দেবদ্রোহী বিলাসী শঙ্কর ! হঠাৎ সে কোন দেবতার প্রতি ভক্তি অর্জন করিয়াছে? এটা কোন দেবতার মন্দির কেতকী ? কেতকী মাথা নাডিয়া বলিল, দেবমন্দির তো নয়। ওর মধ্যে দেবতা নেই। অনন্ত বিস্মিত হইয়া বলিল, বিগ্রহ নেই তো শঙ্কর পুজো করে কার? পাংশুমুখে কেতকী বলিল, কুগ্রহের পুজো করে। দুষ্টগ্রহের পুজো করে। ওর কথা বাদ দাও। সেটা কঠিন কাজ। কেতকীর স্বামীর সম্বন্ধে এত বড়ো কথাটা বাদ দেওয়া যায় না। অনন্ত বলিল, কুগ্ৰহ দুষ্টগ্রহের কথাটা আমায় বুঝিয়ে দাও তো, শুনি। কেতকীর চোখ ছলছল করিয়া আসিল, কী বোঝাব? সাতপুরুষের পাগলামি ওর কাধে ভর করেছে। এখানে এসে থেকে এমন ভয়ংকর কালীভক্ত হয়েছে যে সে আর বলার নয়। ও মন্দিরে কালীমূর্তি আছে, কিন্তু ও কালীমার পুজো করে না, নিজেব পাগলামির পুজো করে।