পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in brbr মানিক রচনাসমগ্ৰ কে, অনন্ত? বলিয়া সে ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেল। বইটা সশব্দে বন্ধ করিয়া বলিল, কিন্তু আসবে। আশা করিনি। তারা! তারা! কত অদ্ভুত ঘটনাই তোমার পৃথিবীতে ঘটে! কী অভ্যর্থনা! অনন্ত হতবাক হইয়া গেল। কেতকী বলিল, আমি ওকে আসবার জন্য চিঠি লিখেছিলাম। বেশ করেছিলে, কিন্তু কথাটা সময়মতো আমায় জানানো বুঝি তুমি উচিত বিবেচনা করিনি? স্বামীর অসম্ভব গভীর মুখের দিকে চাহিয়া কেতকী হাসিয়া ফেলিল। বলিল, না। সময়মতো জানালে তুমি ওকে আসতে বারণ করতে। শঙ্কর একটা অদ্ভুত হাসি হাসিল। তারা! তারা! তোমার সন্তানকে সবাই কী ভুলই বোঝে মা! আসতে বারণ করতাম না কেতকী। অভ্যর্থনাব উপযুক্ত ব্যবস্থা করে আমিও সাদর আহ্বান জানােতাম। ও তোমার বাল্যবন্ধ হতে পারে ; কিন্তু বেশি বয়সে কি বন্ধুত্ব হয় না? এসো অনন্ত, জুতো খুলে ঘরে এসে বোসে । জুতা খুলিয়া ঘরে ঢুকিয়া অনন্ত বেতের কেঁচটাতে বসিল। স্বামীর মন্তব্যের কোনো জবাব না দিয়া কেতকী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি স্নান করবে? उन्मस्छ दलिब्ल, •ा । বারান্দায় জল আছে, মুখ-হাত ধুয়ে নাও তবে। আমি চা করে আনি। কেতকী চলিয়া গেল। শঙ্কর হাই তুলিয়া বলিল, চা আনবে বলে গেল শুনে ভয় পেও না অনন্ত, সব পাবে। হিন্দুর যত কিছু অখাদ্য আছে সব। অনন্ত হাসিয়া বলিল, কী যে তুমি বল শঙ্কর! শঙ্কর বলিল, কী বলি! ও কি হিন্দুর মেয়ে? ও সব পারে। চা-টা খাইয়ে অর্গান বাজিয়ে ও ঠিক তোমায় গান শোনাবে, দেখা ও না পারে কী? অনন্ত বিস্মিত হইল। মৃদুস্বরে বলিল, ওর গান তোমার আর ভালো লাগে না শঙ্কর ? শঙ্কর তীব্ৰকণ্ঠে বলিল, ভালো লাগে ? অপমান বোধ হয়! পাঁচিশ বছর আগে এ বাড়িব বউ অমন গান গাইলে তার কী করা হত জান ? গলা টিপে গান বন্ধ করে জন্মের মতো বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত। বাড়ির বউ, সে গাইবে প্রেমের গান! অনন্ত সত্যই বিস্মিত হইয়া বলিল, প্রেমের গান গায় ? এখানে ? শঙ্কর আনমনে আবার বইটা খুলিয়াছিল, কম্পিত হস্তে কয়েকটা পাতা উলটাইয়া বলিল, ও যখন গান ধরে অনন্ত, এ ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে কুদ্ধ মুখ দেখা দেয়। সব মুখ আমার চেনা। বাবার মুখ ওই ওখানে ফুটে ওঠে,-আঙুল বাড়াইয়া দক্ষিণের দেওয়ালের একটা অনির্দিষ্ট স্থান নির্দেশ করিয়া বলিল, সে কী ভৎসনা তাদের চোখে অনন্ত, একটু তাকিয়ে থাকলে আপনা থেকে মাথা নিচু হয়ে যায়। সাদা ঠোঁট নেড়ে ফিসফিস করে তারা আমাকে বলে কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! অনন্ত প্রত্যেকটি দেওয়ালে দৃষ্টি বুলাইয়া আনিল। কী-ই বা দেখিবার আছে দেওয়ালে ? শ্যাওলাধরা দেওয়ালের উপর চুনকাম করার ফলে যে আবছা অদ্ভুত চিত্রগুলি দেওয়ালের গায়ে ফুটিয়া আছে, মানুষের মুখের সঙ্গে তাঁহাদের কোনো সাদৃশ্যই আবিষ্কার করা যায় না। তবু যেন শঙ্করের পাগলামিতে বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয়। বলা কি যায়! শঙ্করের মুখেই তার পিতৃপুরুষের ইতিহাস সে শুনিয়াছে। আত্মার তৃপ্তি বলিতে যাহা বোঝায়। তার সঙ্গে সেই মানুষগুলির সুদূরতম পরিচয়ও ছিল না। কেতকীর গানের অপমানে জাগিয়া উঠিয়া তারা যদি কোনো ঘরের দেওয়ালে ভুকুটিভরা মুখে উকি দিতে পারে—এ ঘরের দেওয়ালে দেওয়াই সম্ভব। শঙ্কর একাগ্র দৃষ্টিতে অনন্তকে দেখিতেছিল, হঠাৎ কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত করিয়া বলিল, এ কথাটা ওকে বলো না ভাই, ভয় পাবে। ও ভারী ভীরু।