পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in &OO মানিক রচনাসমগ্র ছেড়া চটি দিয়া ঘষিয়া তারক টিকাগুলি গুড়া করিয়া দিল, অনেকগুলো আগুনের কণা উড়িয়া উঠানেব অপর পাশ্বে গিয়া পড়িল। তারকের ধুতিতেও কয়েকটি ছোটো ছোটাে কালো ছিদ্র হইয়া গেল। কুঁকাটা সোজা করিয়া রাখিয়া বিরক্ত তারক আপন মনে বলিল, কী তেজ ওইটুকু আগুনের। এদিকে রান্নাঘরে কুসুম ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। কই গো, এলে? লুচি তোমায় বেলতে হবে না। বাবু, এখানে এসে শুধু বসো, দুটাে কথাবার্তা কই। রান্নাঘরে গিয়ে তারক বলিল, আমি লুচি বেলতে জানি যে বেলব ? আমি বরঞ্চ ভাজতে পাবি। তোমার কিছু পেরে কােজ নেই। বসে বসে তুমি শুধু বকবক করা। বাব্বা, সাবাদিন মানুষেব গলার আওয়াজ শুনতে পাই না। না, দাও আমি ভাজি । লুচি ভাজতে পারব না। কী গো ? তোমার চেয়ে ভালোই পারব। কিন্তু সে পারিল না। প্রথম লুচিখানা ছাড়িতে গিয়া তপ্ত দিয়ে আঙুল ডুবাইয়া ফেলিল। তারপর হাতে পায়ে গায়ে সর্বত্রই ঘি ছিটকাইয়া লাগিল। সর্বাপেক্ষা জখম হইল তার ডান পা-টি। দেখিতে দেখিতে সমস্ত পায্যের পাতা জুড়িয়া এক প্রকাণ্ড ফোসিক পড়িয়া গেল। দেখিলে ভয় করে। তারকের ফোসকাগুলি আর সারিল না। কারণ, সেই রাত্রেই তাহার খুব জুর হইল, ডাক্তাবি ভাষায় যে জ্বরকে মেলিগন্যান্ট বলে, এবং ফোসকা সারিবার ঢের আগে সে গেল মরিয়া। শেষ রাত্রে সে মারা গেল, লোকজন জুটাইয়া খাটুলি ইত্যাদি আনিয়া তাহাকে শ্মশানে লইয়া যাইতে যাইতে পরদিন বেলা এগারোটা বাজিয়া গেল। সেদিন দারুণ দুর্যোগ করিয়াছে, সকাল হইতে ঝড়বৃষ্টিব কামাই ছিল না। একটা মানুষকে ভালো করিয়া পুড়াইতে যত কাঠ দরকার তত কাঠ সংগ্ৰহ করা গেল না। চিতায় শোয়ানোর পর তারকের শরীরের কিছু কিছু অনাবৃত রহিয়া গেল। মুখাগ্নি কবিল কুসুম! চিতার খুব কাছে সে দাঁড়াইযা ছিল। চিতা ভালো করিয়া জুলিয়া উঠিলে যতটুকু সরিষা গেলে আগুনের তাত সহ্য হয় ততটুকুই সে সরিয়া গেল। তার চোখে জল নাই। সম্ভবত আগুনের তাতেই শুকাইয়া গিয়াছে। ইতিমধ্যে দেখা গেল তারকেব। দেহে বড়ো বড়ো ফোসকা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে এবং একে একে ফাটিয়া যাইতেছে। এ সব ফোসকায় জল নাই, শুধু আছে বাষ্প আর বাতাস। কুসুমের মাথার মধ্যে পৃথিবী পাক খাইতেছিল, চিতাটা হাতের নাগালের সূর্য। মূৰ্ছিত হইয়া নয়,—লুচি। মাসখানেক পরে একদিন রাত্ৰিবেলা কুসুম মামাবাডিতে রান্নাঘরে রাঁধিতেছিল। ডাল আর তরকারি রাধিয়া সে ভাত চাপাইয়াছে। ভাত-চাপানোর আগে মামি তাহাকে লুচি ভাজিতে বলিয়াছিলেন— মামার শরীর ভালো নয়। ভাত খাইবেন না। কুসুম লুচি ভাজিতে রাজি হয় নাই। ভয়ে বিবৰ্ণ হইয়া বলিয়াছিল, আর যা বলবেন সব আমি করব মামিমা-লুচি ভাজতে পারব না।