পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SR SRO মানিক রচনাসমগ্ৰ জন্য লাগে। অন্দরের ঘরগুলি তার দখল করিয়া থাকে নিকটতম আত্মীয়স্বজন। বাড়ির একেবারে পিছন দিকে রান্নাঘরের পাশে নিচু ভিটাতে একখানা ছোটাে ঘর আছে। মাঝখানে বেড়া দিয়া ঘবখানাকে দুভাগে ভাগ করিয়া ফেলা হইয়াছে, তাহারই একটা ভাগে কতকগুলি চাষের যন্ত্রপাতির সঙ্গে বাস করে পশুপতি। পাশের ভাগটাতে থাকে কুন্দ, তার দুটি ছেলেকে লইযা। ধরিলে কুন্দ, হয়তো শ্ৰীমস্তের কেহ হয়, না ধরিলে সে পরের চেয়েও পর। কিন্তু শ্ৰীমন্ত বোধ হয় সম্পর্কটা ধরিয়াই এই খোপটাব ঘুটেগুলি অন্যত্র সরাইয়া তাহাকে থাকিতে দিয়াছে। কারণ পশুপতি তাঁর পিতৃবন্ধু, মাননীয় ব্যক্তি। পশুপতির পাশের খোপে যাহাকে তাহাকে শ্ৰীমন্ত থাকিতে দিতে পারে না। রাতটা পশুপতি তার ঘরে ছোটাে একটি চৌকিতে শূইয়া কাঁটায়। দিনের বেলা ঘরের সামনে সংকীর্ণ দাওয়াটির একপ্রান্তে দুপারল চটের উপর পুরু করিয়া বিছানো একটা কঁথায় বসিয়া থাকে। পাশে একটা ওয়াড়বিহীন তেলচিটা বালিশ দেওয়া আছে। বসিয়া বসিয়া শ্ৰান্ত হইয়া পড়িলে কাত হইয়া বালিশে মাথা রাখিয়া সে শয়ন করে। গ্ৰীষ্মকালে এখানে থাকে ছায়া। ঘরের ডাইনে সূর্য উঠিয়া বঁদিকে অস্ত যায়। শীতকালে ঘবেব আড়াল হইতে সূর্য সামনে সরিয়া আসে। বড়ো ঘবেব চাল ডিঙাইয়া, রান্নাঘরের পাশে ঝাকালো আমগাছটার মাথার উপর দিয়া সমস্ত শীতকালটা পশুপতির বসিবার স্থানটিতে রোদ আসিয়া পড়ে। মোটা একটা লেপ গায়ে দিয়াও সমস্ত রাত পশুপতি শীতে হিহি। করিয়া কঁপে, দেহে তাব উত্তাপ এত কম যে শীতে হাড়ের ভিতরে পর্যন্ত যেন একটা জ্বালা কঁপুনি ধরাইযা দেয়। সকালে তার ঘরের সম্মুখ দিয়া যে যায় তাহাকেই সে জিজ্ঞাসা করে, রোদ উঠল গা? হ্যাগো, দাওয়াতে রোদ এল, আঁ? কঁপানাে জডানাে গলায় সে সকলের কাছে রোদের, উত্তাপের, জীবনের আবির্ভাবের সুসংবাদটি শুনিতে চায। কেহ সংক্ষেপে জবাব দিয়া বলে, এই উঠল ; কেহ নিজের বিপুলতর প্রয়োজনে কিছু না বলিয়াই চলিয়া যায়, কেহ নির্বিকার চিত্তে শোনায় হতাশার বাণী ; রোদ কি এত সকলে ওঠে ? ঢের দেরি এখনও দাওয়ায় রোদ আসতে। কুন্দ কোন সকালে উনান ধরাইয়া ডাল চাপাইয়াছে। সে এক সময় আসিযা বলে, কী হাড় কঁপানো জাড় গো বাবা এ বছর! ছেলে-পুলে মোলো। একটু আগুন দেব গো দাদামশায় ? আগে রাত্ৰে শুইতে যাওয়ার সময় উনান হইতে এক মালসা আগুন কুন্দ পশুপতির কাছে রাখিয়া যাইত। কিন্তু একবার মালসার আগুন তার বিছানায় লাগিয়া যাইবার উপক্রম হওয়াব পর হইতে এ ব্যবস্থা রহিত হইয়া গিয়াছে আগুন পোহাইতে গিয়া বুড়ো কি শেযে পুড়িয়া মরিবে! সকালে চারিদিকে অনেক লোক, সে ভয় নাই । পশুপতি সাগ্রহে বলে, দে দিদি, একটুকু আগুন দে তো। কুন্দ মালসায় একটু আগুন করিয়া পশুপতির কাছে রাখিয়া যায়। রোদ উঠিলে কুন্দ অথবা তার বড়ো ছেলে কেশব পশুপতিকে ধরিয়া দাওয়ায় লইয়া যায়। কুন্দর দুবছরের ছোটাে ছেলেটির মতো সেও যেন অবোধ অসহায় শিশু। বার্ধক্যের গোড়াতেই পিছু চলিতে আরম্ভ করিয়া এখন সে যেন আবার তার সেই আদিম অথর্ব শৈশবে গিয়া পৌঁছিয়াছে। পশুপতি দাওয়ায় বসিয়া থাকে নির্বক নিস্পন্দ জড়পিণ্ডের মতো। তার ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই, হৃদয়ে অনুভূতি নাই, মস্তিষ্কে চিন্তা নাই। ঠান্ডায় সে ভিতরে বাহিরে জমিয়া গিয়াছে। চোখ বুজিয়া সূর্যদেবতার অন্ত্যজ ভক্তের মতো সে শুধু সবিনয়ে ব্যাকুল আগ্রহে সূর্যকিরণকে সর্বাঙ্গ দিয়া শুষিয়া লাইতে থাকে।