পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি SR SRS সে বঁাচিতেছে। রাত্রে সে একেবারে মরিয়া গিয়াছিল, এখন আবার বঁচিতেছে। দেহে খানিকটা উত্তাপ সঞ্চিত হইলে সে ঘোলাটে চোখ মেলিয়া তাকায়। প্ৰভাতে আপন আপনি ক্ষুধা তৃষ্ণা হিংসা ও ভালোবাসা লইয়া শ্ৰীমন্তের বৃহৎ পরিবারটি জাগিয়া উঠিয়াছে। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত খেলা ও কর্তব্য পালন চলিবে। পৃথিবীর মাটিতে গাছের ডালে, আকাশে সর্বত্র বিচিত্র চঞ্চল প্ৰাণ। কিন্তু পশুপতির স্থান এই সজাগ উদবিগ্ন ব্যস্ততার বাহিরে, দাওয়ার এই কঁথাটির উপর। তার স্তিমিত নিম্প্রভ জগতে আবছা মানুষগুলি চলাফেরা করে, কেহ কাছে আসিলে মনে হয় কুয়াশার ভিতর হইতে উঠিয়া আসিল। মাঝে মাঝে কারও চিৎকার করিয়া বলা কথার দু-এক টুকরা কথা তার কাছে ভাসিয়া আসে,-বহুদূর হইতে ভাসিয়া আসে। পৃথিবীব মানুষের জীবনে, পৃথিবীর আলো শব্দ ও গন্ধে পশুপতিব্ব দাবি নিঃশেষ হইযা আসিয়াছে। না থােক। পশুপতির বিশেষ কোনো ক্ষোভ নাই। সংসারে নিজেকে প্রয়োজনীয করিয়া বাখিবার উৎসাহও তার শেষ হইয়া আসিয়াছে। কতকগুলি অভ্যাস, কতকগুলি নিয়ম এখনও তাঁহাকে পালন কবিয়া চলিতে হয়, সে তাহা অনেকটা যন্ত্রের মতোই করিয়া যায়—প্রায় বিগড়াইযা-আসা যন্ত্রের মতো। জীবনের অসংখ্য বন্ধন একে একে শিথিল হইয়া আসিয়াছে, জীবনের প্রতি মমতাও বুঝি তার গিয়াছে কমিষা, মানুষেবা প্ৰক্ষিও। আপনার বয়সের দুর্বিষহ ভারটা বহিয়া বহিয়া সে বুঝি ভয়ানক স্বার্থপর হইযা পড়িয়াছে। মানুষেব, তাহাকে যে আশ্ৰয দিয়াছে সেই উপকারক মানুষটি ও তাব পরিবারের, দৈনন্দিন সুখদুঃখের প্রতি তার আসিয়াছে। উদাসীনতা। তবু, ওব মধ্যেই শরীব একটু ভালো থাকিলে সে একটু কৌতুহল বোধ কবে, মনে মনে কী যেন সে ভাবে। ইশারায় শ্ৰীমন্তকে ডাকিযা সে বলে, খেদির জন্য পাত্ৰ দেখা হচ্ছে ? হোক, ভালো কবে খোঁজখবলৈ কব বাবা, মেয়ে বড়ো লক্ষ্মী। গভীর দায়িত্ববোধের উপযোগী মুখভঙ্গি করিয়া পশুপতি জবাবেব প্রতীক্ষা করে। শ্ৰীমন্তের বয়স পঞ্চাশ পার হইয়াছে। মাথার চুল তাবও প্রায় অর্ধেক সাদা হইয়া আসিল। সে অবাক হইয়া বলে, খেদির পাত্র ? সাতবছরে পড়ল না মেয়ে, এখনি পাত্র কীসের ? কথাটা সে দুবােব বলিলে পশুপতি শুনিতে পায়। তার মাথার মধ্যে কেমন একটা গোল বাধিয়া যায়। সায় দিয়া বলে, তা বটে খেদি এখনও ছোটাে বটে খুব। নিঝুম হইয়া একটু ভাবিয়া সে আবার বলে, খেদি নয় গো, বলছি মুখীর কথা। বলছি মুখীর কথা, তুমি শুনিছ খেদি। মুখীর কী হল-পাত্তরের ? যেমন-তেমন একটা জবাব দিয়া শ্ৰীমন্ত তাহাকে বুঝায়। পশুপতির চোখ মিটমিট করে। ক্ষণে ক্ষণে মাথা নাড়িয সে শ্ৰীমন্তের অর্ধেক-শোনা অর্ধেক না-শোনা কথায় সায় দিয়া যায়। মুখীর বিবাহের জন্য তাহার চিন্তা ও উদবেগের যেন সীমা নাই। কিন্তু পশুপতির হৃদয়-যন্ত্রটি একেবারে বিকল ও অসাড় হইয়া যায নাই। কুন্দর জন্য তার বুকে মমতা আছে । হয়তো এই মমতার মর্মকথাটি এই যে কুন্দর সেবা তার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেটা দোষের কথা নয়। মানুষের ধর্মই এই, সাতাশি বছর বয়সেও মানুষকে এই ধৰ্মই পালন করিতে হয়। সেবা হােক, মমতা হােক, তোযামোদ হােক, অর্থ হােক, দুপক্ষের প্রয়োজন আছে বলিয়াই সংসারে এ সবের আদান-প্ৰদান চলে । শোয়ার আগে কুন্দ যখন পশুপতির খবর লইতে আসে, রাত্রি তখন অনেক। চারিদিক নিস্তব্ধ। পশুপতি এক একদিন ফিসফিস করিয়া বলে, দরজা বন্ধ করা দিদি।