পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in NR RNR মানিক রচনাসমগ্ৰ কুন্দ দরজা বন্ধ করিলে পশুপতি আরও বেশি ফিসফিস করিয়া বলে, দেখ তো আছে কী নেই ? কুন্দ হাতের ডিাবরি নামাইয়া চৌকির তলে উকি দেয়। টিনের ছোটাে তোরঙ্গ চৌকির কোণের পায়ার সঙ্গে দড়ি দিয়া শক্ত করিয়া এখনও বাঁধা আছে, কেহ লইয়া যায় নাই। পশুপতি শঙ্কিত হৃদয়ে অপেক্ষা করে। কুন্দ সিধা হইয়া তার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলে, আছে দাদামশাই, যাবে কোথা ? পশুপতি নিশ্চিত হইয়া বলে, তোকে দিয়ে যাব দিদি, তোর কেউ নেই তোকেই দিয়ে যাব। এটা স্তোকবাক্য নয়, টিনের তোরঙ্গটি পশুপতি সত্যসত্যই তাহাকে দিয়া যাইবার কামনা পোষণ করে। কুন্দও যে লোভ না করে এমন নয়। কিন্তু বােকসে কী আছে পশুপতি স্পষ্ট করিয়া কিছু বলে না। তার ভাসাভাসা জবাবে এইটুকু বুঝিতে পারা যায় যে ব্যাকসে গহনা আছে, টাকা আছে, অনেক লোভনীয় দামি জিনিস আছে, কুন্দ এতটা বিশ্বাস করে না। কিছু টাকা আছে, দু-একশো। বাকসোটা কুন্দ একদিন সন্তৰ্পণে নাড়িয়াও দেখিয়াছে। ভিতরে ঝমােঝম শব্দ হয়। কুন্দর ছোটাে ছেলেটিকে পশুপতি ভালোবাসে। সকালে দাওয়ায় দুটি মুড়ি ছড়াইয়া কুন্দ ছেলেটাকে তার কাছে বসাইয়া দিয়া যায়। খোকার দিকে তাকাইয়া ফোকলা মুখে পশুপতি একটু হাসে। দুটি শুষ্ক শীর্ণ হাত তার দিকে বাড়াইয়া দিয বলে, আ আ—মণি আ—সোনা আ—— বেশ একটু সুর করিয়াই যেন বলে। দু-আঙুলে একটি মুড়ি খুঁটিয়া মুখে তুলিতে গিয়া তার কচি দাঁত কটি চিকমিক করিয়া খোকাও হাসে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। খোকাকে কোলে করিয়া আদর করিবার সামর্থ্য পশুপতিব নাই। হাত বাডাইয্য ওকে সে ছুইতে পারে, ডাকিয়া ডাকিয়া কাছে আনিতে পারে, ওর গায়ে মাথাব্য বুলাইতে পারে হাত। আর কিছু পারে না। খোকা টালিতে টলিতে হাটিতে পারে। একদিন সে পশুপতির গায়ের উপর ঝাপাইয়া পডিয়াছিল। খোকা জানিত মার মতো পশুপতিও এতে খুশি হইবে এবং যে ভাবেই সে বাপ দিবে দুহাতে তাহাকে সে তৎক্ষণাৎ ধরিয়া ফেলিবে। কিন্তু খোকাকে সামলানো দূরে থাক, পশুপতি নিজেই তুমড়ি খাইয়া পড়িয়া গিয়াছিল। দুজনেই সেদিন কাদিয়াছিল-জীবনের দুই প্রান্তের দুটি শিশু। খোকার কান্না বাড়িব লোকে শুনিয়াছিল। আর পশুপতির কান্না দেখিয়াছিল। দন্তহীন মুখখানি হাঁ করিয়া অবলা প্রাণীর মতো সে কঁদিয়াছিল। সামান্য বাথাও সে আজকাল সহিতে পারে না। দেহের কোথাও তুচ্ছ এতটি আঘাত লাগিলে বহুক্ষণ অবধি তার সর্বাঙ্গ বেদনায় কনকিন করিতে থাকে। অথচ আঘাত মাঝে মাঝে লাগেই । কুন্দর অনেক কাজ। সব সময় তাহাকে হাতের কাছে পাওয়া যায় না। লাঠিতে ভর দিয়া পশুপতিকে উঠিতে হয়। তিনটি পায়ের সাহায্যে কষ্টে সে নিচু দাওয়া হইতে নীচে নামে, আরও কষ্টে দাওয়ায় ওঠে। চৌকাটি ডিঙাইয়া ঘরে যায় এবং বাহিরে আসে। পড়িয়া যাওয়ার মতো ভয়ানক ব্যাপার কদাচিৎ ঘটে, কিন্তু প্রায়ই পায়ে হেঁচট লাগে, লাঠিটা মাথায় ঠকিয়া যায়, চৌকির কোণে হাঁটুর কাছে ঠোক্কর লাগে। কোনো রকম শ্বাস রোধ করিয়া ঘরের শয্যায় অথবা দাওয়ার আশ্রয়ে পৌঁছিয়া পশুপতি অনুশ্বাসীয় হাহা শব্দে কাতরতা প্ৰকাশ করে, তার স্তিমিত চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়ে। একদিন কুন্দর বড়ো ছেলে কেশব তাহাকে প্রাণান্তকর আঘাত দিয়াছিল। খোকার মতো সেও এক রকম পশুপতির গায়ের উপরে আছড়াইয়া পড়িয়াছিল। তবে ইচ্ছা করিয়া নয়।