পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in SR SR 8 মানিক রচনাসমগ্ৰ মূল্য আছে। তাঁহাকে দুবার আহা শুনাইয়া কেশবকে একটু বকিয়া এ ব্যাপার তো সকলে শেষ করিয়া দিতে পারিত! তাব বদলে একেবারে সমারোহ বাধিয়া গিয়াছিল! কয়েক বছর ধরিয়া পশুপতির মনে একটা কষ্ট ছিল। তার মনে হইত, এতকাল বঁচিয়া আছে বলিয়া সকলে বুঝি বিরক্ত হইয়া পড়িয়াছে, মরণকে এ ভাবে ঠেকাইয়া রাখিয়া মানুষের কাছে সে বুঝি অপরাধ করিতেছে। কবে সে মরিবে তারই প্রতীক্ষায় কারও আর ধৈর্য নাই। ব্যাপারটা চুকিয়া গেলে সকলে হাঁপ ছাড়িয়া বঁাচে । ছেলে বৰ্মা পালানোর আগে বৃদ্ধিবয়সে যে পরিমাণ আরাম ও সুখ পশুপতি কল্পনা করিত তার কিছুই সে পায় নাই। চারিদিক হইতে আসিয়াছে শুধু অবহেলা, অনাদর। সকলে তাহাকে যেন ছটিয়া ফেলিতে চায়। দিনের পর দিন যত সে অসহায় হইয়া পড়িয়াছে, মানুষকে তার প্রয়োজন হইয়াছে যত বেশি, মানুষ তার তত দুরে সরিয়া গিয়াছে। মানুষের সুখদুঃখে পশপুতি আর ভাগ বসাইবার কামনা রাখে না, জীবনের সমারোহে তার বরং বিতৃষ্ণাই আসিয়াছে। কিন্তু মরিতে মরিতেও বঁচিযা আছে বলিয়া সকলে রাগ করিবে, তার অপরিহার্য সেবা ও যত্ন সে পাইবে না, জীবনের শেষ দিনগুলো কষ্ট ও অসুবিধায় ভবিয়া থাকিবে, এটা সহ্য করা একটু কঠিন। দুমাসের জন্য কেহ বিদেশ যাওয়ার আয়োজন করিলে মানুষের কাছে হঠাৎ তাহাব দাম বাড়িয়া যায়। সে চিরকালের জন্য বিদেশের চেয়েও সুদূর বিদেশে চলিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে, অথচ মানুষের কাছে তার দাম গোল কমিয়া। কোমরে ঘা খাইয়া সকলকে ব্যস্ত করিতে পারিয়া পশুপতির এই দুঃখটা কমিয়া আসিয়াছে। সে বুঝিতে পারিয়াছে, মৃত্যুর সঙ্গে তার নিবিড় ঘনিষ্ঠতাকে মানুষ অবহেলা করে নাই, মর্যাদা দিয়াছে।। জগতে সে নিরাশ্রয়, তার ছেলে থাকিয়াও নাই। তাহার দেহ পঙ্গু, মন কুয়াশায আধ অন্ধকার। তবু পথে পথে তাহাকে যে আজ ভিক্ষা করিতে হয় না, একটি ঘেরা আশ্রয় ও দুটি অন্ন যে তাহার জুটিতেছে, সে শুধু তার বয়সের জন্য, মরিতে তার বেশি দিন বাকি নাই বলিযা। বেশি কিছু হয়তো মানুষ দেয় নাই, কিন্তু যতদিন-সেনা মরে ততদিন তার বাঁচিযা থাকার অধিকারকে স্বীকার করিয়াছে সকলেই। এবং জীবনেব সঙ্গে তাহার সম্পর্ক প্রায় চুকিয়া আসিয়াছে বলিয়াই পরেব বাডি থাকিয়া পরান্ন ভোজনে তাহার লেজাও নাই। সেদিনের ব্যাপার পশুপতিকে এই সাস্তুনা দিয়াছে কিন্তু তার পর হইতে কুন্দ ও কেশব একটু পদলাইয়া গিয়াছে। কুন্দ করিয়াছে রাগ আর কেশব পাইয়াছে ভয়। কুন্দ মুখে কিছু বলে নাই, রাগ দেখাইয়াছে কাজে। তার কাছে যে পরিমাণ সেবা পশুপতি না চাহিয়াই পাইত এখন আর সে রকম পায় না। পশুপতির টিনের তোরঙ্গটি চৌকির পায়ার সঙ্গে আজও বাধা আছে। তাছাড়া বুড়া অসহায় মানুষকে একেবারে ত্যাগ করিবার ইচ্ছা কুন্দর ছিল না। সে সাহসও ছিল না। সাহস না থাকার কাবণ এই। পশুপতিকে শ্ৰীমন্ত ও তার পরিবার যতই ভুলিয়া যাক কুন্দ যে তার সেবা করে এটা তাহারা জানিত এবং এই ব্যবস্থাই সকলে মানিয়া লইয়াছিল! রান্না করার মতো এও কুন্দর একটা কর্তব্য। তবে ইচ্ছা করিলে আইন বঁাচাইয়া রাজার আইনও ভাঙা যায়। কুন্দও তেমনিভাবে নিজেকে বঁাচাইয়া পশুপতিকে মাবিতেছিল। শেষেব দিকে শীত আরও তীক্ষ হইয়া উঠিয়াছে। ভোরে মৃতপ্রায় বৃদ্ধটিকে এক মালসা আগুন দেওয়ার সময় কুন্দ করিয়া উঠিতে পারে না। কোনোদিন রোদ উঠিয়া পড়িলেও পশুপতিকে সেখানে পৌছাইয়া দিতে না আসে কুন্দ না আসে কেশব, সারারাত শীতে জমিয়া গিয়া নিজে নিজে বাহিরে যাওয়ার শক্তিও পশুপতি তখন খুজিয়া পায় না। কোনোদিন দেখা যায় তার ছেড়া চট ও ছেঁড়া কঁথা রাত্রে কেহ তুলিয়া রাখে নাই, বাড়ির লোম-ওঠা বুড়া কুকুরটা