পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in অতসী মামি აvsტ\s) সৃষ্টি হইয়াছে। তেঁতুল গাছটাব জমকালো আবছা চেহারা দেখিলে গা ছমছম করে। ভরপুর পুকুরের বুকে শ্যামার হাতের আলো যে লম্বা সোনালি পাত ফেলিয়াছে, প্রত্যেক মুহুর্তে হাজার বৃষ্টির ফোঁটায় তাহা অজস্র টুকরায় ভাঙিয়া যাইতেছে। নীলমণি থমকিয়া দাঁড়াইল। কাতর স্বরে বলিল, ও শ্যামা, পার হব। কী করে! শ্যামা বলিল, জল বেশি নয় বাবা, নিমুর হাঁটু পর্যন্তও ওঠেনি। চলে এসো। সুখের বিষয় স্রোতের নীচে কাদা ধুইয়া গিয়াছিল, নীলমণির পা অথবা লাঠি আটিয়া গিয়া তাহাকে বিপন্ন করিল না। তবু, এতখানি সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও, নীলমণির দুচোখ একবার সজল হইয়া উঠিল। বাহির হওয়ার সময় সে কাপড়টা গায়ে জড়াইয়া লইয়াছিল, এখন ভিজিয়া গায়ের সঙ্গে আটিয়া গিয়াছে। খানিকক্ষণ হইতে জোর বাতাস উঠিয়াছিল, নীলমণির শীত করিতে লাগিল। জগতে কোটি কোটি মানুষ যখন উষ্ণ শয্যায় গাঢ় ঘুমে পােশ ফিরিয়া পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিতেছে— সপরিবারে অক্ষম দেহটা টানিয়া টানিয়া সে তখন চলিয়াছে কোথায়? যে প্রকৃতির অত্যাচারে ভাঙা ঘরে টিকিতে না পারিয়া তাহাকে আশ্রয়ের খোঁজে পথে নামিয়া আসিতে হইল, সেই প্রকৃতিরই দেওয়া নির্মমতায় হয়তো সরকাররা দরজা খুলিবে না, ঘুমের ভান করিয়া বিছানা অাঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকিবে। না, নীলমণি আর যুঝিয়া উঠিতে পারিল না। তাহার শক্তি নাই, কিন্তু আক্ৰমণ চারিদিক হইতে ; পেটের ক্ষুধা, দেহের ক্ষুধা, শী হাঁ বর্ষা, রোগ, বিধাতার অনিবার্য জন্মের বিধান,-সে কোন দিক সামলাইবে? সকলে যেখানে বঁচিতে চায়, লাখো মানুষের জীবিকা একা জমাইতে চায়, কিন্তু কাহাকেও বাঁচাইতে চায় না, সেখানে সে বঁাঁচিবে কীসের জোরে ? স্রোত পার হইয়া গিয়া লণ্ঠনটা উচু করিয়া ধরিয়া শ্যামা দাঁড়াইয়া আছে। পাশেই ভরাট পুকুরটা বৃষ্টির জলে টগবগা করিয়া ফুটিতেছে। নীলমণি সাঁতার জানিত না। কিন্তু জানিত যে পুকুরের পাড়টা এখানে একেবারে খাড়া। একবার গড়াইয়া পড়িলেই অর্থই জল, আর উঠিয়া আসিতে হইবে না। নিভা তাড়া দিতেছিল। শ্যামা বলিল, বাবা, চলে এসো। দাঁড়ালে কেন ? নীলমণি চলিতে আরম্ভ করিল, ডাইনে নয় বায়েও নয়। সাবধানে, সোজা শ্যামার দিকে। হঠাৎ শ্যামা চিৎকার করিয়া উঠিল, মাগো, সাপ! পবক্ষণে আনন্দে গদগদ হইয়া বলিল, সাপ নয় গো সাপ নয়, মস্ত শোল মাছ! ধরেছি। ব্যাটাকে । ইঃ, কী পিছল! তাড়াতাড়ি আগাইবার চেষ্টা করিয়া নীলমণি বলিল, শক্ত করে ধর, দুহাত দিয়ে ধর-পালালে কিন্তু মেরে ফেলব শ্যামা! সরকাররা বছর তিনেক দালান তুলিয়াছে। এখনও বাড়িসুদ্ধ সকলে বাড়ি বাড়ি করিয়া পাগল। বলে, বেশ হয়েছে, না? দোতলায় দুখানা ঘর তুললে, বাস, আর দেখতে হবে না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর সরকারদের বড়োছেলে বাহিরের ঘরের দরজা খুলিল। বলিল, ব্যাপার কী? ডাকাত নাকি? নীলমণি বলিল, না ভাই, আমরা। ঘরে তো টিকতে পারলাম না ভায়া, সব ভেসে গেছে, ভাবলাম, তোমাদের বৈঠকখানায় তো কেউ শোয় না, রাতটুকু ওখানেই কাটিয়ে আসি। বড়োছেলে বলিল, সন্ধ্যাবেলা এলেই হত ! নীলমণি কষ্টে একটু হাসিল ; সন্ধ্যায় কি বৃষ্টি ছিল ভাই! দিবি ফুটফুটে আকাশ-মেঘের চিহ্ন নেই। রাতদুপুরে হঠাৎ জল আসবে কে জানত।