পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in S8b. মানিক রচনাসমগ্র সুপ্রিয়া তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করল, কেন হত না ? পাঁচ বছর এই বুনো দেশে পড়ে থাকা সহ্য হচ্ছে, পেট ভরাবার জন্য পরের দাসীবৃত্তি করছি, গোরুবাছুরের সেবা করে আর ঘর গুছিয়ে জীবন কাঁটাচ্ছি—ঝিমিয়ে পড়েছি। একেবারে। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালে আমার সহ্য হত না কেন ? হেরম্ব বলল, দাসীবৃত্তি করছিস নাকি? সুপ্রিয়া তার সহিষ্ণুতা অক্ষুন্ন রেখে বলল, ধরতে গেলে, কথাটা তাই দাঁড়ায বইকী! হেরম্ব আবার মাথা নেড়ে বলল, না তা দাঁড়ায় না। দাঁড়ালেও পৃথিবীসুদ্ধ সব মেয়ে হাসিমুখে যে কাজ কবছে, তার বিরুদ্ধে তোর নালিশ সাজে না। চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটানো তুই হয়তো খুব মজার ব্যাপার মনে করিস। আসলে কিন্তু তা নয। আর্থিক পরাধীনতা স্বীকার করবার সাহস যে মেয়ের নেই তাকে কেউ ভালোবাসে না। তাছাড়া,- এইখানে ইজিচেয়ারের দুইদিকেব পাটাতনে কনুইয়ে ভর রেখে হেরম্ব সামনে দিকে একটু কুঁকে পড়ল, তাছাড়া স্বাধীনতা তোর সইত না। কতকগুলি বিশ্ৰী কেলেঙ্কারি করে জীবনটা তুই মাটি করে ফেলতিস ? সুপ্রিয়া সংক্ষেপে শুধু বললে, ইস! ইস নয়। ওই তোর প্রকৃতি। পনেরো বছর বয়সেই তুই একটু পেকে গিয়েছিলি, সুপ্রিয়া। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে মেয়েরা সারা জীবনের একনিষ্ঠতা অর্জন করে, তোর মধ্যে সেটা পনেরো বছর বয়সে এসেছিল। তখনই তোব জীবনের দুটাে পথ তুই একেবারে স্থির করে ফেলেছিলি। তাব একটা হল লেখাপড়া শিখে স্বাধীন হয়ে থাকা, আর একটা-হেবম্বকে একটু থামতে হল,—অন্যটা এক অসম্ভব কল্পনা । সুপ্রিয়া আবার পলকহীন চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, অসম্ভব কেন ? হেরম্ব চেয়ারে কাত হয়ে এলিয়ে পড়ল। যা তুই, রান্নাঘর থেকে একবার ঘুরে আয়গে। ভাগ। হেরম্বের আদেশে নয়, আতিথ্যের প্রয়োজনেই সুপ্রিয়াকে একসময়ে বান্নাঘরে যেতে হল। মনে তার কঠিন আঘাত লেগেছে। সংসারে থাকতে হলে সংসারের কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হয়, এটা সুপ্রিয়া জানে এবং মানে। বিয়েই যখন তার করতে হল তখন মোটা মাইনের হাকিম অথবা অধ্যাপক অথবা পয়সাওয়ালা ডাক্তারের বদলে একজন ছোটো দারোগার সঙ্গে তাকে গেথে দেওয়া হল কোন ভেবে তাব কখনও আপশোশ হয়নি ? বিয়ের ব্যাপারে বাধ্য হয়ে মানুষকে যে সব হিসাব ধরতে হয় সেদিক থেকে ধরলে কোনো ছেলেমেয়েই সংসারে ঠিকে না। এক বড়ো দারোগা যাচাই করতে এসে তাকে পছন্দ করেনি। তার নাকটা যে বেঁচা সে অপরাধও সেই বড়ো দারোগার নয়। একটি চোখা না কেব। জন্য কষ্ট করে বড়ো দারোগ হয়ে তাকে বাতিল করে দেওয়াটা সুপ্রিয়া তার অন্যায় মনে করে না। তবু কিশোর বয়সের কল্পনাটি অসম্ভব কেন, সুপ্রিয়া তার কোনো সঙ্গত কাবণ আবিষ্কার করতে পারেনি। তার হতাশ বেদনা আজও তাই ফেনিল হয়ে আছে। চেনা মানুষ, জানা মানুষ, একান্ত আপনার মানুষ। যে নিয়মে অচেনা অজানা ছোটাে দারোগা তার স্বামী হল, ওই মানুষটির বেলা সে নিয়ম খাটবে কেন? ও খাটতে দেবে কেন? এ কী বিস্ময়কর অকারণ অন্যায় মানুষের। কেন, ভালোবাসা বলে সংসারে কিছু নেই নাকি? সংসারের নিয়মে এর হিসাবটা পুঁজিবার ফাক নেই নাকি? সুপ্রিয় ভাবে। এত ভাবে যে বছরে তার দু-তিনবার ফিট হয়। সুপ্রিয়াকে ডালভাত রাঁধতে হয় না, একজন পড়ে সিপাহি বেগার দেয়। সুপ্রিয়া রাধে মাছ তরিতরকারি, রাধে ছানার ডালনা। গৃহকর্মকে সে সত্যসত্যই এত ভালোবেসেছে যে, মাছের ঝোলের