পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in SRVSR মানিক রচনাসমগ্ৰ হেরম্ব বলল, এতকাল পরে এইখানে সমুদ্রের ধারে আপনার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে, এ কথা কল্পনাও করতে পারি না। বছর বারো আগে মধুপুরে আপনার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল, মনে আছে ? অনাথ বলল, আছে। সেবাব দেখা হয়ে না থাকলে আপনাকে হয়তো আজ চিনতেই পারতাম না। সত্যবাবুব বাড়ি মাস্টারি করতে করতে হঠাৎ আপনি যেদিন চলে গেলেন, আমার বয়স বারোর বেশি নয়। তারপর কুড়ি একুশ বছব কেটে গেছে। আপনার চেহারা ভোলবার মতো নয়, তবু মাঝখানে একবার দেখা হয়ে না থাকলে আপনাকে হয়তো আজ চিনতে না পেরে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম । অনাথ একটু নিস্তেজ হাঁসি হাসল। আমাকে চিনেও চিনতে না পাপাই তোমার উচিত ছিল হেরম্ব। আমার মধ্যে ও সব বাহুল্য নেই মাস্টারমশায়। সত্যবাবুর মেয়ে কেমন আছেন? ভালোই আছেন। হেরম্ব অবিলম্বে আগ্রহ প্ৰকাশ করে বলল, চলুন দেখা কবে আসি। অনাথ ইতস্তত করে বলল, দেখা করে খুশি হবে না হেরম্ব। কেন ? মালতী একটু বদলে গেছে।--অনাথ পুনরায় তার স্তিমিত হাসি হাসল। হেরম্ব বলল, তাতে আশ্চর্যের কী আছে? এতকাল কেটে গেছে উনি একটু বদলাবেন বইকী ! আপনি হয়তো জানেন না, ছেলেবেলায্য আপনার আর সত্যবাবুর মেয়ের কথা যে কত ভেবেছি তার ঠিক নেই। আপনাদেব মনে হত বৃপকথার রহস্যময় মানুষ। অনাথ বলল, সেটা বিচিত্র নয। ও সব ব্যাপারে ছোটো ছেলেদের মনেই বেশি আঘাত লাগে। তারা খানিকটা শুনতে পায, খানিকটা বড়োরা তাদের কাছ থেকে চেপে রাখে। তার ফলে ছেলেরা কল্পনা আরম্ভ করে দেয। তাদের জীবনে এব। প্রভাব কাজ করে। আচ্ছা, তুমি কখনও ঘূণা করনি আমাদেব ? না। সংসারেব সাধারণ নিয়মে আপনাদের কখনও বিচাব করতে পারিনি। মধুপুরে আপনাদেবী সঙ্গে যখন দেখা হল, আমি ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। হয়তো ছেলেবেলা থেকেই আপনাকে জািনবার বুঝবার জন্য আমার মনে প্রবল আগ্রহ ছিল। এখনও যে নেই সে কথা জোব করে বলতে পারব না। আমার মনে যত লোকোব প্রভাব পডেছে, বিশ বছব অদৃশ্য থেকেও আপনি তাদেব মধ্যে প্রধান হয়ে আছেন। অনাথ নিশ্বাস ফেলে বলল, ভগবান! পৃথিবীতে মানুষ একা বেঁচে থাকতে আসেনি—সকলের এটা যদি সব সময় খেয়াল থাকত! মালতীকে না দেখলে তোমার চলবে না হেব্বস্ব ? হেব্বস্ব ক্ষুন্ন হয়ে বলল, আপত্তি করছেন কেন ? অনাথ তাব কঁধে হাত রেখে বলল, দুর্বলতা। মনের দুর্বলতা হেরম্ব, চলো। শহরেব নির্জন উপকণ্ঠে সাদা বাড়িটি পার হয়ে হেরম্বের মনে হল, এইখানে শহর শেষ হয়েছে। অনেকক্ষণ সমুদ্রেব অর্থহীন অবিরাম কলরব শূনে হেরম্বের মস্তিষ্ক একটু শ্ৰান্ত হয়ে পড়েছিল। এখানে সমুদ্রের ডাক মৃদুভাবে শোনা যায়। হেরম্বের নিজেকে হঠাৎ ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল। অনাথ গভীর চিন্তামগ্ন অন্যমনস্ক অবস্থায় পথ চলছে। হেরম্ব তাকে প্রশ্ন করে জবাব পায়নি একটারও। বেলা আর বেশি অবশিষ্ট নেই। পথের দুপাশে খোলা মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে রাখালেরা গোরুগুলোকে একত্র করছে। পথ সোজা এগিয়ে গিয়েছে সামনে ।