পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in দিবারাত্রির কাব্য 2ܪ ܓ) তোমাকে দেখে আনন্দ হচ্ছে। তাই বললাম। ছেলেদের তুমি কী পাড়াও বললে ? হেরম্ব হেসে বলল, কবিতা পড়াই। ভালো ভালো ইংরেজ কবির বাছা বাছা খারাপ কবিতা । বেঁচে থেকে সুখ নেই মালতীবউদি। আকস্মিক দার্শনিক মন্তব্যে মালতী হাসল। গলার শ্লেষ্মা সাফ করে বলল, সুখী? নাইবা রইল সুখ । সুখ দিয়ে কি হবে ? সুখ তো শুটকি মাছ! জিভকে ছোটোলোক না করলে স্বাদ মেলে না। সুখ স্থান জুড়ে নেই, প্রেম দিয়ে ভরে নাও, আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করা। সুবিধা কতা! মদ নেই যদি, মদের নেশা সুধায় মেটাও । ব্যস, আর কী চাই ? হেরম্ব মালতীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দিন সুধা। আমি দেব ? মালতী জোরে হেসে উঠল, আমার কী আর সে বন্যাস আছে! তবে একটু জল দিন। তেষ্টা পেয়েছে। তা বরং দিতে পারি। বলে মালতী ডাকল, আনন্দ, আনন্দ ! একবার বাইরে শুনে যাও। আনন্দ কে ? হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল। আমার অনন্ত আনন্দ । মনে নেই ? মধুপুরে দেখেছিলে। চুম খেযে কীদিয়ে ছেড়েছিলে। ওঃ আপনাব সেই মেয়ে। তাব কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলে ? তুমি অবাক মানুষ হেরম্ব । সে কি আমার ভুলবার মতো মেয়ে ? হেরম্ব বলল, ছ৮ো ছোটো ছেলে মেয়েদের কথা আমার মনে থাকে না মালতী বউদি। আপনার মেযে তখন খুব ছোটােই ছিল নিশ্চয় ? মালতী স্বীকার করে বলল, নিশ্চয় ছোটাে ছিল। ছোটাে না থাকলে চুমু খেযে তাকে কঁদাতে কী কবে তুমি । তাছাড়া, তখন ছোটাে না থাকলে মেয়ে তো আমার অ্যাদিনে বুড়ি হয়ে যেত! তারপর্ব এল আনন্দ । আনন্দকে দেখে হেরম্ব হঠাৎ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পডল। আনন্দ অপসারী নয়, বিদ্যাধবী নয়, তিলোত্তম নয, মোহিনী নয। তাকে চোখে দেখেই মুগ্ধ হওযা যায, উত্তেজিত হয়ে ওঠাব কোনো কারণ থাকে না। কিন্তু হেরম্বেব কথা আলাদা। এই মালতীকে নয, সত্যবাবুর মেয়ে মালতীকে সে আজও ভুলতে পারেনি। এই স্মৃতির সঙ্গে তার মনে বারো বছর বয়সের খানিকটা ছেলেমানুষি, খানিকটা কঁচা ভাবপ্রবণতা আজও আটকে রয়ে গিয়েছে। আনন্দকে দেখে তব মনে হল সেই মালতীই যেন বিশ্ব-শিল্পীর কারখানা থেকে সংস্কৃত ও বুপান্তরিত হয়ে, গত বিশ বছর ধরে প্রকৃতির মধ্যে, নাবীর মধ্যে, বোবা পশু ও পাখির মধ্যে, ভোরের শিশির আর সন্ধাতবার মধ্যে বুপ, রেখা ও আলোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তাকে তৃপ্ত করার যোগ্যতা অর্জন করে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শীতকালের ঝরা শুকনো পাতাকে হঠাৎ একসময় বসন্তের বাতাস এসে যে ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আনন্দের আবির্ভাবও হেরম্বেব জীর্ণ পুরাতন মনকে তেমনিভাবে নাড়া দিয়ে দিল। বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে সে আনন্দকে দেখতে লাগল। তার মনের উপর দিয়ে কুড়ি বছর ধরে যে সময়ের স্রোত বয়ে গেছে, তাই যেন কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে এসেছে। এই উচ্ছসিত আবেগ হেরম্বের মনে প্রশ্রয় পায়। আবেগ আরও তীব্র হয়ে উঠলেই সে যেন তৃপ্তি পেত। তার বন্দী কল্পনা দীর্ঘকাল পরে হঠাৎ যেন আজ মুক্তি পায়। তার সবগুলি ইন্দ্ৰিয় অসহ্য উত্তেজনায অসংযত প্ৰাণ সঞ্চয় করে। চারিদিকের তরুলতা তার কাছে অবিলম্বে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শেষ অপরাহ্রের রঙিন সূর্যালোককে তার মনে হয় চারিদিকে ছড়িয়ে-পড়া রঙিন স্পন্দমান জীবন।